লেন্ডিং রেট বাড়ানোর পক্ষে ব্যাংকাররা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুদহার বৃদ্ধির কারণে তাৎক্ষণিক বিনিয়োগে প্রভাব না পড়লেও ব্যাংকের তারল্যের উপর কিছুটা প্রভাব আসবে। এর ফলে মার্কেটে লেন্ডিং রেট বাড়বে। তাই ফিক্সড (স্থায়ী) লেন্ডিং রেট থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
নতুন পলিসি হিসেবে সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পলিসি রেট (রেপো সুদহার) নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে এই হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে।
প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংক এই হার সংশোধন করল। এর আগে ২০২০ সালে জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে আসতে পারে।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে দেশে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। এ আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার টাকা খরচ করতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। যার ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য কমে আসছে। এরই মধ্যে রেট বাড়ার কারণে দেশের আমদানির পরিমাণ বাড়তে থাকায় ডলার সংগ্রহ করতে গিয়ে অধিক টাকা খরচ করতে গিয়ে তারল্য সংকটে ভুগছে ব্যাংকগুলো। নতুন রেপো রেট বাড়ানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন বলেন, 'ক্লিয়ার মেসেজ হলো মার্কেটে টাকার টান আছে। এখন পলিসি রেট বেড়ে গেছে এর মানে হচ্ছে ইন্টারেস্ট রেট বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলো আগে ৭.৫০% কর্পোরেট ঋণ দিচ্ছিল। এখন এটা উপরের দিকে চলে যাবে, এখনই সরকারের উচিত ইন্টারেস্ট রেটের দিকে নজর দেয়া। আর এর জন্য এখনই সঠিক সময়। বর্তমানের রেটে আমাদের ঋণ বিতরণ করা তো খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।'
এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম আউলিয়া বলেন, প্রায় সব ব্যাংকে তারল্য সংকট যাচ্ছে। এরই মধ্যে রেপো রেট বৃদ্ধি কিছুটা সমস্যা করবেই। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকা উইথড্র করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সমস্ত কারণে ব্যাংকগুলোর ফান্ডে যদি শর্টেজ থাকে তাহলে যথার্থ লেন্ডিং করা যাবে না। আর ক্যাপ থাকার কারণে লেন্ডিং থেকে তো যথার্থ আয় আসবে না। আমাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যাবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের লেন্ডিং রেট বাড়ানোর জন্য নজর দেয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে গ্রাহকের আমানতের সর্বনিম্ন সুদ হার হবে মূল্যস্ফীতির বেশি তাই মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে আমাদের ডিপোজিট রেট ফিক্সড করতে হবে। আর ডিপোজিট রেট বাড়ানো তো আমাদের জন্য কঠিন কারণ আমাদের তো লেন্ডিং রেটে ক্যাপ দেয়া আছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, গত বছরের জুনে ব্যাংকগুলোর এক্সেস লিকুইডিটি ছিলো ২৩১,২১০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এসে এক্সেস লিকুইডিটির পরিমাণ দাড়িয়েছে ১৯৯,৯৭৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই নয় মাসে এক্সেস লিকুইডিটি কমেছে ৩১,২৩৬ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রেপো রেট বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলোর কস্ট কিছুটা বাড়বে। যে ঋণের রেট ৯ এর নিচে আছে সেখানে এর ফলে কিছুটা প্রভাব পড়বে। রেপো রেট তো সাময়িক সময়ে লিকুইডিটি মেটানোর জন্য।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বাড়ানোর মানে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানোর একটা সংকেত। এছাড়া ব্যাংকের সুদের হারের পরিবর্তন আনা হবে অথবা অন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে সে ধরণের একটা সংকেত বহন করছে। তবে কোন ধরণের পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না লেন্ডিং রেটে পরিবর্তন আনা হবে কিনা।
বহির্বিশ্বে অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট বাড়িয়েছে তবে তাদের ইন্টারেস্ট রেট হচ্ছে বাজার নির্ধারিত। তাই তাদের পলিসি রেট বাড়লে সবক্ষেত্রে রেট বেড়ে যায়। তবে আমাদের ক্যাপ থাকার কারণে সেটার সুযোগ কম।
প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, দেশে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যে পরিমাণে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকগুলো এখনো আমানতের ক্ষেত্রে এ রেটে সমন্বয় করেনি। আমাদের এখন যে কস্ট অব ফান্ডস রয়েছে তা অতটা প্রভাব ফেলছে না। তবে আমাদের আমানত ও ঋণের স্প্রেড যদি কমে আসে তবে অবশ্যই লেন্ডিং রেট বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চিত্র অনুযায়ী, চলতি বছরে এপ্রিলের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.২৯%। যা গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ৫.৩৬%। এরপর থেকে টানা নয় মাস দেশের মূল্যস্ফীতির হার উর্ধ্বমুখী লক্ষ্য করা গেছে।