আনডিসপুটেড ট্যাক্স পরিশোধ না করলে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে ব্যবসার ইউটিলিটি পরিষেবা
মামলা নেই কিংবা মামলায় ট্যাক্স অথরিটি জিতেছে, ব্যবসায়ীদের কাছে আটকে থাকা এমন আনডিসপুটেড ট্যাক্স আদায়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা পানির সংযোগের মত পরিষেবা বিচ্ছিন্ন করার জন্য ট্যাক্স অফিসারদের ক্ষমতা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
আগামী ৯ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপনকালে এমন প্রস্তাব আসতে পারে।
অর্থমন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট সংশিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে আনডিসপুটেড ট্যাক্স আদায়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ স্থানান্তর এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার মত বিধান থাকলেও এর বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা তেমন নেই।
এজন্য এধরনের ট্যাক্স আদায়ে এনবিআরের ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস (ডিসিটি) দের আলোচ্য ক্ষমতা দেওয়ার কথা ভাবছে এনবিআর। ডিসিটিরা এসব পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা নেবেন।
তবে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, বর্তমান বাস্তবতায় এমন প্রস্তাব যৌক্তিক হবে না। সারা পৃথিবীতেই বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে তা ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভুল বার্তা যাবে।
তবে রাজস্ব বিভাগ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকারের নিরঙ্কুশ পাওনা আদায়ে কঠোর হওয়া ছাড়া রাজস্ব আদায় বাস্তবে সম্ভব হয় না। এজন্য এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করে যদি রাজস্ব আদায় করা যায়, তা যৌক্তিক।
যেসব ট্যাক্স নিয়ে এনবিআরের ট্যাক্স আপিলেট ট্রাইব্যুনালে মামলা আছে কিংবা হাইকোর্টে মামলা বা আপিল রয়েছে, ওইসব মামলায় জড়িত ট্যাক্স হলো ডিসপুটেড। আর যেসব মামলায় এনবিআর জিতেছে কিংবা এনবিআর অ্যাসেসির (মূল্যায়নকারী) কাছে দাবিনামা জারি করলেও তিনি তা ফেস করেন নি, সেক্ষেত্রে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওই ট্যাক্স আনডিসপুটেড হিসেবে গণ্য হয়।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ওই সব ট্যাক্স আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না বলে ট্যাক্স বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আনডিসপেুটেড ট্যাক্স এর পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার উপরে। বছরের পর বছর ধরে এসব অর্থ ঝুলে থাকলেও ফিল্ড লেভেল ট্যাক্স অফিসগুলো তা আদায় করতে পারছে না।
এছাড়া রাজস্ব বিভাগের আপিলের ট্রাইব্যুনাল এবং হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে আরো ৩৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।
আইনে কী আছে এবং বাস্তবে কী হচ্ছে
বিদ্যমান ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ এর ১৪২ ও ১৪৩ ধারায় নিরঙ্কুশ ট্যাক্স আদায়ের উপায় সম্পর্কে বলা আছে। আইনি বিধান অনুযায়ী, এসব ট্যাক্স আদায় করার জন্য ডিসি অফিসে সার্টিফিকেট মামলা করা যায়।
সেক্ষেত্রে ডিসি অফিস থেকে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ট্যাক্স আদায়ের জন্য।
এছাড়া ১৪৩ ধারা অনুযায়ী, মূল্যায়নকারীকে শুনানির সুযোগ দেওয়ার পরেও কর শোধ না করলে এই জাতীয় মূল্যায়নকারীদের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত যেকোনো পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহ বন্ধ করতে পারবেন করের ডেপুটি কমিশনার। কর শোধ করার আগ পর্যন্ত বা শোধের কোনো সন্তোষজনক ব্যবস্থা করার আগ পর্যন্ত পরিষেবা বন্ধ রাখতে পারবেন তিনি।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার জন্যও ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিতে পারেন করের ডেপুটি কমিশনার।
তবে আয়কর বিভাগের মাঠ পযায়ের অফিসগুলোতে কথা বলে জানা গেছে, আলোচ্য পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অ্যাটাচমেন্ট ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতি বাস্তবে প্রয়োগ হয় না কিংবা তা কার্যকরও নয়।
রাজধানীর একটি ট্যাক্স জোনের একজন ডিসিটি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি কখনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কথা শোনেন নি। তবে কখনো কখনো তারা ব্যাংক হিসাব জব্দ করেন। এছাড়া ডিসি অফিসের মাধ্যমে সার্টিফিকেট মামলা করেও খুব একটা কাজ হয় না।
তিনি বলেন, "আমার জোনে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আনডিসপুটেড ট্যাক্স রয়েছে। আমরা ব্যাংক অ্যাটাচমেন্টের বাইরে অন্যান্য পদক্ষেপ সাধারণত নেই না।"
গত অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে নিয়োজিত সাবেক এনবিআর সদস্য মো. আলমগীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, কখনো অ্যাসেসি বেপরোয়া হলো কিংবা কোন নোটিশের জবাব না দিলে, নোটিশ ঠিকমতো সার্ভ না হলে, অ্যাসেসির ঠিকানা পরিবর্তন হলে কিংবা বিদেশে থাকলে তিনি ট্যাক্স অফিস থেকে পাঠানো নোটিশের জবাব দিতে পারেন না।
সেক্ষেত্রে কিছু আইনি নিয়ম মেনে ওই ট্যাক্স আনডিসপুটেড হয়ে যায়। আবার মামলা করার পর অ্যাসেসি মামলা ফেস করলেন, কিন্তু হেরে গেলেও তা অবিতর্কিত হয়।
বর্তমানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অ্যাটাচমেন্ট ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতিগুলো তেমন কার্যকর নয়।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) উপদেষ্টা এবং বাণিজ্য আইন বিশেষজ্ঞ মনজুর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সারা দুনিয়া কর কমানো কিংবা মওকুফ করার মত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই অবস্থায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা লাগিয়ে কর আদায় চাওয়া যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে না।"
সাবেক এনবিআর সদস্য ডক্টর সৈয়দ মো. আমিনুল করিম টিবিএসকে বলেন, "খারাপ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকারের পাওনা আদায়ে এমন প্রস্তাব আসলে তা অযৌক্তিক হবে না। কেননা নিরঙ্কুশ পাওনা আদায়ে কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই।"
অবশ্য সাবেক সদস্য মো. আলমগীর হোসেন মনে করেন, গ্যাস, পানি কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রমটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দিতে পারে। কেননা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সহায়তা করবে, তা দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, "এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ব্যাংক অ্যাটাচমেন্ট এর মত অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে। আবার যে মামলাটি আনডিসপুটেড বলে পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে, পরবর্তীতে অ্যাসেসি যদি মামলা লড়েন কিংবা আইনি পন্থায় যান, তখন তো তা আবার ডিসপুটেড হয়ে যাবে। সেসময় ওই বিচ্ছিন্ন লাইন সংযোগের কী হবে?"
বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থা, তখন এমন প্রস্তাব দেওয়া ঠিক হবে কিনা, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।