আশুগঞ্জ পাওয়ার: প্রকল্পের সুফল পুরনো সেই দীর্ঘসূত্রিতাতেই বাঁধা
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বড় বিদ্যুৎ উৎপাদক- আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ২০১৯ সালে দুটি নতুন কেন্দ্রের জন্য বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু, পরিকল্পনা নিয়ে এদিক-সেদিক করায় পিছিয়ে যায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এবং পরিশেষে কোনোপ্রকার সুফল না এলেও, বন্ডে বিনিয়োগকারীদের সুদ দিতে হচ্ছে।
ফলত; রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানিটির ব্যাংকিং খাতের বাইরের বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়নের উদ্যোগ–তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠেছে– এপর্যন্ত অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্জিত আয় থেকে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১০০ কোটি টাকা বিভিন্ন মেয়াদে সুদ দিয়েছে।
আশুগঞ্জ পাওয়ারের সূত্রগুলি জানায়, ঋণ নেওয়া অর্থে ৯ শতাংশ সুদ দিতে হওয়ায় তা কোম্পানির মোট আয়কে চাপের মুখে ফেলছে।
সুদের বোঝা তো রয়েছেই, তার ওপর আগামী মাসেই বন্ড ম্যাচিউরিটি পাবে এবং তখন বিনিয়োগকারীদের আসল শোধের ভার নিতে হবে কোম্পানিটিকে।
তহবিলের ৪০০ কোটি টাকা দুটি বিদ্যুকেন্দ্রের পেছনে ব্যয় করা হয়– ২,৯৩১ কোটি টাকার আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (ইস্ট) এবং পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট– যার শুধু ভূমি উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৮১৯ কোটি টাকা।
এ বছরের জুনের পর কার্যক্রম শুরু হবে আশুগঞ্জ প্লান্টে, অন্যদিকে পটুয়াখালী প্লান্টের জন্য শুধু ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
তহবিলের বাকি ২০০ কোটি টাকা স্বল্প-মেয়াদি আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে- যাত সুদ মিলবে ৪.৫ শতাংশ হারে। তবে এ থেকে পাওয়া বার্ষিক জমার অঙ্ক বিনিয়োগকারীদের সুদ প্রদানের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্যই কোম্পানিটিকে অন্যান্য কেন্দ্র থেকে অর্জিত আয়ের একটি অংশ সুদ পরিশোধের জন্য আলাদা করে রাখতে হচ্ছে।
এনিয়ে জানতে চাইলে, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির- কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আবুল মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ডটি ইস্যু করা হয়। তাই এখানে লাভ বা ক্ষতি বড় বিষয় নয়। এখন আমরা অন্যান্য প্রকল্পের আয় থেকে সুদ পরিশোধ করছি। যেসব প্রকল্পের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে সেগুলি সচল হলে এসব খরচ তখন সমন্বয় করা যাবে।"
ক্রমবর্ধমান সুদের বোঝা
বন্ড ইস্যু করার মাত্র তিন মাস পর–২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটি বার্ষিক গড়ে ৯ শতাংশ হারে ৫৪ কোটি টাকা পরিশোধ করছে।
বন্ডের বাধ্যবাধকতা অনুসারে, আশুগঞ্জ পাওয়ারের সংগৃহীত তহবিলের ৮.৫ থেকে ১০.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করার কথা। এর আগে, সংস্থাটি তহবিলে ১০ শতাংশ সুদ দিয়েছিল, গত বছর তারা ৮.৫ শতাংশ হারে সুদ দিয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যানুসারে, বন্ডের ট্রাস্টি ৫ জুলাই ২০২১ থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত - বন্ডের ফেসভ্যালুর ওপর ৬ মাসের জন্য ৩য় কুপন পেমেন্টে ৮.৫০ শতাংশ কুপন রেট নির্ধারণ করেছে।
কোম্পানির অভ্যন্তরীণরা বলেছেন, গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশুগঞ্জ পাওয়ারকে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে বলেছে। ইতোমধ্যেই বন্ডের সুদ পরিশোধ নিয়ে টানাটানির মধ্যে থাকায়- সাম্প্রতিক পদক্ষেপটি কোম্পানির জন্য আরেকটি ধাক্কা বলে মনে করছেন তারা।
৬০০ কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি পাবলিক প্লেসমেন্টে ৫০০ কোটি টাকা এবং পাবলিক অফারের মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। প্রথম রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় আশুগঞ্জ পাওয়ার। ২০২০ সালের এর বন্ড ট্রেডিং শুরু হয়।
দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট। সরকারি খাতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৮ শতাংশ বা ১,২৯৭ মেগাওয়াট সক্ষমতাসহ ছয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট রয়েছে কোম্পানিটির।
নিজস্ব অর্থায়ন ক্ষমতা শক্তিশালী করার পাশাপাশি বন্ড বাজারকে বিনিয়োগকারীদের কাছে জনপ্রিয় করতে, আশুগঞ্জ পাওয়ার তার দুটি পাওয়ার প্ল্যান্টে অর্থায়নের জন্য প্রথম সরকারি কোম্পানি হিসেবে বন্ড বাজারে প্রবেশ করে।
আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পে পুরো তহবিল বিনিয়োগ করতে না পারায় আমরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যাংকে জমা দিয়েছিলাম। এখন সমস্যা হল আমাদের বন্ডে বেশি সুদ দিতে হবে, কিন্তু আমানতের হার কমে যাওয়ায় আমাদের সুদ থেকেও আয় কম।"
এই ব্যবধান কোম্পানির আয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তবে এটি সাময়িক, একবার প্ল্যান্ট চালু হলে কোম্পানি তা কাটিয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পটুয়াখালী প্ল্যান্টের বাস্তবায়ন ঘিরে অনিশ্চিয়তা
সরকারের বাতিল করা ১০টি কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পটুয়াখালী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বাতিল করা প্রকল্পটি এখন এলএনজিভিত্তিক হিসেবে গড়ে তোলা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে এলএনজি অবকাঠামো উন্নয়নে ৩-৪ বছর সময় লাগবে, তবে কাজ কবে শুরু হবে- তা এখনও অনিশ্চিত।
তৃতীয়বারের মতো মেয়াদ বাড়ানোর পরও ৮১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের শুধু ভূমি উন্নয়ন সম্পন্ন হয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এজন্য প্রায় ৯২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশের বেশি আর আর্থিক অগ্রগতি ২৭.৮৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ ২০২১ সালের এপ্রিলের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মহামারিজনিত শাটডাউনের কারণে এটি এক বছর পিছিয়েছে। আশুগঞ্জ পাওয়ার সূত্রে জানা গেছে, প্ল্যান্টটি এখন জুনের মাঝামাঝি সময়ে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।