পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার উদ্যোগে আপত্তি করবেন না: অর্থমন্ত্রী
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার উদ্যোগে বাধা না দিতে আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে অনেকে টাকা ফেরত আনতে উৎসাহী হবেন।
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক, তাই সরকার সেগুলো ফেরত আনার চেষ্টা করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, 'এই সুযোগ না দিলে টাকা ফেরত আসবে না, তাতে দেশের কি লাভ হবে? তাই এ সুযোগ দেওয়ায় আমাকে গালি দিয়ে কোনো লাভ হবে না।'
শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী আরও বলেন, যেখানে সুখ বেশি, বিলাসিতা আছে, মানুষ সেখানে চলে যায়। 'কেউই টাকা স্যুটকেসে ভরে পাচার করে না। আমরা এখন ডিজিটাল যুগে বাস করি। টাকা পাচার করার বিভিন্ন মেকানিজম আছে। বিভিন্ন কারণে টাকা বিদেশে পাচার হয়।'
পাচারের টাকা দেশে ফেরত আনতে ৭% কর, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি হলে ১৫% এবং অস্থাবর সম্পত্তি ১০% কর দিয়ে বৈধতা পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা এটোকে 'অনৈতিক' উল্লেখ করে বলেছেন, এতে করদাতাদের অর্থপাচারে আগ্রহ বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ১৭টি দেশ পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছে।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেন, ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার জন্য দায়মুক্তির ঘোষণা দিয়ে ৯.৬ বিলিয়ন ডলার ফেরত পেয়েছে।
তিনি জানান, পিকে হালদারের পাচার করা টাকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করেছে ভারত। আর কানাডা সরকার বলেছে, টাকা পাচার করে নিয়ে যারা ওই দেশে সম্পদ করেছে, তাদের টাকা ফেরত পাঠাবে এবং নতুন করে কানাডায় সম্পদ কেনা বন্ধ করা হবে।
'বাংলাদেশ থেকে যদি পাচার হয়ে থাকে, তাহলে সেটা এদেশের মানুষের হক। সেটাই ফেরত আনার চেষ্টা করছি। আপনারা দয়া করে এ কাজে বাধা দেবেন না,' জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, পাচার হওয়া কিংবা কালো টাকার পুরোটাই ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত নয়। 'সিস্টেমের কারণেও কিছু কিছু টাকা অবৈধ হয়ে যায়। অনেকেই জমি বিক্রি করে পুরো টাকা প্রদর্শন করে না, তখন তা অপ্রদর্শিত অর্থ হয়ে যায়।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমরা প্রত্যাশা করবো, কেউ টাকা ফেরত আনলে তা নিয়ে সরকারের কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না, এবং তিনিও প্রশ্নবিদ্ধ হবেন না। আর যারা নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে দেশেই সম্পদ রাখছেন, তাদের সম্মানও কমবে না।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সময় থেকেই বিভিন্ন সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। 'তবু এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হবে,' অর্থমন্ত্রী বলেন।
২০০৭ সালে দায়িত্ব নেওয়া সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গঠিত ট্রুথ কমিশন অবৈধ সম্পদ ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ দিলেও তা নিয়ে পরে প্রশ্ন উঠেছিল।
এখন পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা হলে তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'ওই সময় দেশে সাংবিধানিক সরকার ছিল না। আমরা নির্বাচিত, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সরকার এবং আমাদের সরকারের ধারাবাহিকতাও আছে। তাই সাংবিধানিকভাবে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতেও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ট্রুথ কমিশন গঠনের সময় সংসদ ছিল না, তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আইন দ্বারা সমর্থিত ছিল না। কিন্তু এবার আইনের মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা কোন প্রশ্ন তুলবে না।
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়ে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্য তুলে ধরে এক সাংবাদিক জানতে চান, বছরে দেশ থেকে ৬৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। তাহলে অর্থপাচার প্রতিরোধকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস-এর কর্মকর্তাদের জনগণের করের টাকায় রেখে লাভ কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, '৬৬ হাজার কেন, বাংলাদেশ থেকে ৬৬ টাকা পাচার হয়েছে—এমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা যখন কোনো তথ্য পাই, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দেশের অনেকের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে, অনেকে জেলেও আছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির বলেন, 'সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা পাচারের যেসব তথ্য গণমাধ্যমে আসে, তার ৯৫%-ই অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশিরা সুইস ব্যাংকে রেখেছেন। বাংলাদেশ থেকে পাচার করে কেউ সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।'