বন্ড লাইসেন্স নিয়ে এনবিআরের অটল সিদ্ধান্তে উদ্বেগে ক্ষুদ্র পোশাক রপ্তানিকারকরা
বন্ড লাইসেন্সবিহীন কারখানার বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে আইনি সংশোধনে বানিজ্য মন্ত্রণালয় সুপারিশ করলেও তৈরি পোশাক কারখানার জন্য বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার শর্তে অনড় অবস্থানে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআরের এ সিদ্ধান্তের কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ১১ শতাধিক আরএমজি ও হোমটেক্সটাইল কারখানা বাকিতে ও ভ্যাট ছাড়া পণ্য ক্রয় জটিলতায় পড়তে যাচ্ছে। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট পুঁজির রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়তে পারে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আইন মেনে এবং রপ্তানির জন্য তৈরি হওয়া পোশাকের কাঁচামালের সঠিক হিসাব রাখতে তদারকির স্বার্থে নতুন এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
বাকিতে ও ভ্যাট ছাড়া পণ্য ক্রয়ের সুবিধা পেয়ে থাকে বন্ড লাইসেন্সধারী কারখানাগুলো। বন্ড লাইসেন্সবিহীন রপ্তানিকারকরাও এতোদিন ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে বাকিতে পণ্য ক্রয় ও ভ্যাট ছাড়া পণ্য ক্রয়ের সুবিধা পেতেন।
যেহেতু ছোট আকারের রপ্তানিকারকদের নিজস্ব বন্ড লাইসেন্স নেই, তাই তাদের আমদানি করার জন্য বন্ড আছে এমন তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে সুতা ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিকের মতো কাঁচামাল নিতে হবে।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রচ্ছন্ন রপ্তানির (যারা কাঁচামাল বিক্রি করে) সুবিধা পেতে হলে শর্ত মানতে হবে। বন্ড লাইসেন্স থাকতে হবে।
এর অর্থ হলো, বন্ড লাইসেন্স বিহীন রপ্তানিকারকরা ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে বাকিতে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন না এবং ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
এর শিকার হবে মূলত দেশের নিটওয়্যার খাতের কারখানা, যারা স্থানীয় উৎস থেকে থেকেই শতভাগ কাঁচামাল সংগ্রহ করে ব্যাংক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে।
এ পরিস্থিতিতে নন-বন্ডেড কারখানাগুলোর রপ্তানির স্বাভাবিক গতি অব্যাহত রাখতে ফের বানিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে গত বৃহস্পতিবার চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসােসিয়েশন (বিটিএমএ) এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিকেএমই'র নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে জানিয়ে এই সময় পর্যন্ত নন-বন্ডেড রপ্তানিকারকদের স্বাভাবিক ব্যাক টু ব্যাক এলসি'র অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
অন্যদিকে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে এনবিআরের কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই শর্ত মানতে হলে ছোট পুঁজির কারখানাগুলোর রপ্তানিতে টিকে থাকতে পারবে না, যা শেষ পর্যন্ত দেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে ক্ষতির মুখে ফেলবে।
এ খাতের নেতারা বলছেন, বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য যেসব শর্ত মানতে হয়, তা ছোট পুঁজির রপ্তানিকারক কারখানার পক্ষে মানা বাস্তবে সম্ভব নয়। আবার লাইসেন্স নেওয়ার সময় ও পরবর্তীতে যে পরিমাণ 'আলাদা খরচ' করতে হয়, তাও বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
তারা বলছেন, নতুন এ শর্তের মাধ্যমে আসলে ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের বদলে ব্যবসাকে কঠিন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে রপ্তানিকারক এসব নন-বন্ডেড পোশাক কারখানা যে ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে পন্য ক্রয় করে আসছে, তাতে তো কোন সমস্যা হয়নি। এখন
ব্যাক-টু-ব্যাক এলসিতে একজন আমদানিকারক রপ্তানিকারককে এলসি ইস্যু করতে পারেন, আর রপ্তানিকারক ওই এলসির বিপরীতে বাকিতে পণ্য ও কাঁচামাল কিনতে আরেকটি এলসি ইস্যু করতে পারবে।
বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, কোন রপ্তানিকারক রপ্তানি আদেশের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে বাকীতে স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ক্রয় করতে হলে তার বন্ড লাইসেন্স থাকতে হবে। তবে এ নীতিমালা থাকলেও গত প্রায় তিন দশক ধরেই বন্ড লাইসেন্সবিহীন আরএমজি রপ্তানিকারকরা ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল ক্রয় করে আসছিলেন।
সমস্যা দেখা দেয় ২০১৪ সালে এনবিআর থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠার পর। এরপর ২০১৪ সাল থেকেই এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধনের জন্য রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে দেনদরবার ও চিঠি চালাচালি চলতে থাকে।
সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে এনবিআর বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়ে নন-বন্ডেড কারখানার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি না খুলতে অনুরোধ জানানো হয়।
এর পর টনক নড়ে সব পক্ষের। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের উপস্থিতিতে বানিজ্যমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সভায় সমস্যা সমাধানে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
একাধিক সভার পর ওই টাস্কফোর্স ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার জন্য রপ্তানিকারক বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের বন্ড লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা রহিত করে এনবিআরের ভ্যাট আইনে ও বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশে সংশোধনী আনার পরামর্শ দেয়।
কিন্তু এর পর গত এপ্রিলে বানিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত আমদানি নীতি আদেশে সংশোধনী আসেনি। আর এনবিআরও অনেকটা তাদের আগের অবস্থান বজায় রেখেই চিঠি দিলো।
এনবিআরের একজন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত সুবিধা নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তদারকির একটা ব্যবস্থা তো থাকতে হবে। লাইসেন্স না থাকলে ওই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পন্য আসলেই রপ্তানি হলো কিনা, কিংবা কতটুকু অপব্যবহার হলো, তা দেখার উপায় কী?
বন্ড লাইসেন্স নিতে অনীহা কেন?
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বন্ড লাইসেন্সবিহীন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১৫০, যেখানে প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
এনবিআরের নিয়ম অনুযায়ী, একটি রপ্তানিমুখী কারখানাকে বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য প্রায় ৩০ ধরণের শর্ত পরিপালন করতে হয়, যার মমধ্যে কয়েকটি শর্ত একটি ছোট পুঁজির কারখানার পক্ষে মানা সম্ভব হয় না।
নারায়নগঞ্জ ভিত্তিক কাসপিয়ান সোয়েটারস লিমিটেডের বার্ষিক রপ্তানি ৬ লাখ ডলারের কম, প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কামরুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা লাইসেন্স নিতে চাই। কিন্তু যে কঠিন শর্ত রয়েছে, তা পূরণ করা আমাদের মত ছোট পুঁজির রপ্তানিকারকদের পক্ষে সম্ভব নয়।"
২০২০ সালে এসে আরো বেশ কয়েকটি শর্ত যুক্ত হয়, যা বড় বিনিয়োগের রপ্তানিকারক ছাড়া পরিপালন করা সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একজন রপ্তানিকারক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বছর বছর লাইসেন্স নবায়ন করা, অডিট করার নামে বন্ড অফিসের কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ টাকার দাবিও ছোট উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার অন্যতম কারণ।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বন্ডে কী হয় তা সবাই জানেন।
"নিচের লেভেলে (রেভিনিউ অফিসার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেভিনিউ অফিসার) ঘুষ ছাড়া কোন কথা নেই। টাকা না দিলে ফাইলে এমন সমস্যায় ফেলবে, উপরের লেভেলের কর্মকর্তাদের পক্ষেও তা সমাধানের সুযোগ থাকে না। বন্ড লাইসেন্সধারীদের প্রতিটি অডিটে কী পরিমাণ টাকা দিতে হয়, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানেন।"