অনলাইনে মিথ্যা তথ্যের কারণে ৫ জনের একজন মেয়ে নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত: জরিপ
অনলাইনে মিথ্যা তথ্যের কারণে প্রতি ৫ জনের একজন মেয়ে (২০ শতাংশ) নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত এক বৈশ্বিক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
২৬টি দেশের ২৬ হাজারেরও বেশি কিশোরী ও যুব নারীদের উপর জরিপ পরিচালনা করা হয় এই গবেষণার মাধ্যমে, যেখানে দেখা যায়, এই কিশোরী ও যুব নারীদের কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়াকে প্রভাবিত করে এই সকল মিথ্যা ও ভুল তথ্য এবং গুজব।
এই গবেষণা ফলাফল কিশোরী ও যুব নারীদের জীবনে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের প্রভাবের বাস্তব পরিণতি তুলে ধরে- এমন মন্তব্য করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল শিশু এবং যুবদের জন্য প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিশ্চিতে সকল দেশের সরকারদের প্রতি আহ্বান জানায়।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তিনজনের একজন জানায়, মিথ্যা তথ্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাদের চিন্তিত, আতংকিত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত বিশদ সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে পাওয়া তথ্যমতে, অনলাইনে মতামত আদানপ্রদানের ফলে কমিউনিটির মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সামাজিক উত্তেজনার কারণে তারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করে।
অন্যান্যরা তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত বানোয়াট অনুষ্ঠান বা আয়োজন নিয়ে যা তাদের শারীরিক ঝুঁকির মুখে ফেলে। পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন অবিশ্বস্ত স্বাস্থ্য উপদেশ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৮ শতাংশই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোন মিথ্যা তথ্য বা কুসংস্কার বিশ্বাস করেছে। অপরদিকে প্রতি ৪ জনের ১ জন, অর্থাৎ ২৫% কোভিড-১৯ এর টিকা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেই প্রশ্ন করেছে অনলাইন মাধ্যমে।
সমগ্র বিশ্বের ২৬টি দেশ থেকে অংশ নেওয়া কিশোরী ও যুব নারীদের প্রতি ৫ জনের একজন (১৯%) জানিয়েছে, অনলাইনে মিথ্যাচার এত বেশি যে তারা নির্বাচনের ফলাফলকে অবিশ্বাস করেছে, অন্যদিকে পাঁচজনের মধ্যে একজন (১৮%) এই মিথ্যাচারের কারণে রাজনীতি বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
জরিপের ফলাফল মতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের কিশোরী ও যুব নারীদের অনলাইনে অবিশ্বস্ত বা মিথ্যা তথ্যের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং উচ্চ আয়ের দেশের মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক মেয়ে কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহণ করবে কি না এই প্রশ্ন করেছে।
অনলাইনে ভুল তথ্য ও অসত্য তথ্যের লিঙ্গভিত্তিক প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য এই প্রথম বৃহৎ আকারের বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১০ জনের মধ্যে প্রায় নয়জন কিশোরী ও তরুণী (৮৭%) মনে করে যে এটি তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিশ্বব্যাপী, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই বিশ্বস্ত তথ্য পেতে বিশ্বাস করে এমন কোন অনলাইন উৎস এই জরিপে পাওয়া যায় নি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবারের সদস্য এবং সরকারের উর্ধ্বে অংশগ্রহণকারীদের ৪৮% মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে বিশ্বাস করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে।
জরিপ মতে, ৬৫% অংশগ্রহণকারীর মতে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এর পরেই আছে টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউব (সবগুলো ২৭%)।
ওয়েলস এ বসবাসকারী শারল্যেট (ছদ্মনাম) নামে একজন এই জরিপে অংশ নিতে গিয়ে বলেন, ইন্টারনেটে মিথ্যা তথ্যের আধিক্য মানুষকে "খুব, খুব বিপদাপন্ন" করে দিতে পারে।
"আমি মনে করি কখনও কখনও অনলাইন দুনিয়ায় জবাবদিহিতার অভাব থাকে যার ফলে এখানে যে কেও প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি না হয়ে যা কিছু করতে পারে," তিনি ব্যাখ্যা করেন।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ পলিসি'র নির্বাহী পরিচালক ভাগ্যশ্রী ডেংগলে জানান, "মেয়েদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা, তারা কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিবে এবং তাদের চারপাশের জগতকে একটি আকৃতি দেয় ইন্টারনেট। আমাদের গবেষণায় এটি স্পষ্ট যে, অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব জীবনের পরিণতি রয়েছে। এটি বিপজ্জনক, এটি মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং এটি তাদের জনজীবনে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে।"
"প্রতিদিন, স্থান নির্বিশেষে, কিশোরী ও যুব নারীরা তাদের শরীর, তাদের পরিচয় এবং তাদের আচরণ নিয়ে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ও চিরাচরিত ধ্যানধারণা দ্বারা অনলাইনে জর্জরিত থাকে। তাদের পণ্যায়িত ও লজ্জিত করতে ছবি ও ভিডিও ম্যানুপুলেট করা হয়। শোষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুজব। এবং মেয়েদের অন্যতম বাস্তব ভয় যে বানোয়াট অনুষ্ঠান এবং নকল প্রোফাইল তাদের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে অফলাইনেও বিপদ ডেকে আনতে পারে।"
"মেয়ে আমি সমানে সমান" ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী মেয়েদের সাহায্য করছে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে যেন তারা শিশু ও যুবদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিশ্চিতে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাদের মিথ্যা তথ্য চিহ্নিতকরণে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে, এবং অনলাইনে আত্মবিশ্বাসের সাথে বিচরণে যোগ্য করে তোলে।
সংস্থাটির জরিপে আরো দেখা যায়, প্রতি ১০ জনের ৭ জন মেয়ে (৬৭%) তাদের স্কুলে কখনোই ভুল ও মিথ্যা তথ্য চিহ্নিতকরণ সম্পর্কে পড়ে নি।
কেনিয়ার নাগরিক ২০ বছর বয়সী মিয়া (ছদ্মনাম) জানান, আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছি যেখানে সবকিছু ইন্টারনেটের মাধ্যমে হচ্ছে। আমরা সবকিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে করছি। তাই আমি মনে করি প্রযুক্তিগত শিক্ষাও স্কুলের প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেওয়া উচিত। যাতে করে, আমরা যখন বড় হয়ে উঠবো, আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেই বিষয়ে আরো পরিষ্কার ধারণা রাখবো।"
বাংলাদেশের নাগরিক আঁচল (২১) বলেন, "যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঝুকি আছে, আমি সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলি, সেই অ্যাকাউন্টগুলো আনফলো করে দেই সোস্যাল মিডিয়া থেকে, যাতে এইসব ভুল তথ্য আমার প্রতিদিনের জীবনযাপন আর মানসিক সবাস্থ্যের ক্ষতি করে।"
ভাগ্যশ্রী আরো বলেন, "মেয়েদের নিরাপদ সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাদের জীবনের উপর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতে সত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন, মেয়েরা জানে না কী বিশ্বাস করতে হবে, কাকে বিশ্বাস করতে হবে এবং কোথায় সত্য খুঁজতে হবে।"
ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বের জন্য আমাদের মেয়েদের এবং সমস্ত শিশুদের দক্ষ করে তুলতে হবে। এজন্যই আমরা শিক্ষা কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্ত করতে মেয়েদের আহ্বানকে সমর্থন করছি।