'আমি আইএস-এর এক নেতাকে বিয়ে করেছিলাম' অভিজ্ঞতা জানালেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী তানিয়া
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী তানিয়া জয়া, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) নেতার সঙ্গে তার পরিচয় এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেছেন দ্য গার্ডিয়ানে লেখা এক নিবন্ধে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বসবাসকারী এই নারী উগ্রবাদ নিয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এবং তা মোকাবিলায় কিছু পরামর্শও দেন।
এক আইএস বধূর অভিজ্ঞতা:
১৯৮৩ সালে উত্তর লন্ডনের একটি বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারে জন্ম আমার। ছোট্ট থেকে আমার আগ্রহ ছিল ইংরেজ হয়ে ওঠার, কিন্তু আমার পরিবার চাইতো আমি যেন একজন আদর্শ মুসলিম মেয়ে হই। তারা পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। এই সমাজের সঙ্গে পুরোটাই বেমানান ছিল তারা। নিজের বাবা-মা'কে বিশ্বাস না করা গেলে, পৃথিবীর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না- এভাবেই সব রকমের কর্তৃপক্ষের প্রতি আমার মনে সন্দেহ জন্মালো।
আমি যখন ১৭ বছর বয়সী, আমার পরিবার তখন পূর্ব লন্ডনের নতুন বাসায় উঠেছিল। সেখানে আমার নতুন অনেক বন্ধু হলো। কিন্তু, তারা সকলেই ছিল খুবই সংরক্ষণশীল এবং ধার্মিক মেয়ে। তাদের চোখে আমিই বরং ছিলাম বেশি পশ্চিমা ঘেঁষা। এমন প্রতিক্রিয়া মানসিক জগতে বড় প্রভাব ফেলেছিল, আমার ভেতরে হতাশা থেকে নতুন ব্যক্তিত্ব ধারনের ইচ্ছা জন্ম নিল।
আমার এক চাচাতো বোন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়েই কট্টরপন্থি হয়ে উঠেছিল, এসময় সে আমার মনোজগত পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে। সে আমাকে খেলাফতের কথা বলেছিল। তার উৎসাহেই অনলাইনে অনেক বেশি সৌদি আলেমদের ফতোয়া পড়া শুরু করি। বিশ্বাস ছিল আমি কেবল সত্যেরই সন্ধান করছি।
২০০৩ সালে আমি লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইরাক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে যোগ দেই। সেখানে কিছু মানুষ আমাকে কয়েকটি কাগজ দেয়, এরমধ্যে একটি মুসলিম ডেটিং সাইটের ঠিকানাও ছিল। ওই সাইটের সূত্রেই আমি জন জর্জেলাস নামক ধর্মান্তরিত এক মার্কিন মুসলিমের সন্ধান পাই। যুক্তরাষ্ট্রের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা, সুদর্শন ও বহুভাষী এই যুবকটিকে আমার খুবই মনে ধরেছিল। তাকে অনুসরণ করা শুরু করেছিলাম ধীরে ধীরে।
জন যখন প্রথমবার লন্ডনে আসে তখনই আমাদের বিয়েটা হয়। পরিবার ছাড়ার ইচ্ছে থেকেই দ্রুত ওর সঙ্গে বিয়ে করি। এরপর আমরা দুজনে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি, এবং আমাদের ঘরে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। আমার অবশ্য সুখ ততদিনে নষ্ট হওয়ার পথে। জন দিন দিন আরো কট্টরপন্থার অনুসারী হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে, আমি নেকাব পড়া ছেড়ে আরো বেশি স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠা শুরু করেছিলাম।
দুজনের মতাদর্শ না মিললেও সংসার টিকে ছিল। এ অবস্থায় ২০০৬ সালে একটি ইসারায়েলি লবিং গ্রুপের ওয়েবসাইট হ্যাকের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় জন। ওকে তিন বছরের জেল দেওয়া হয় এজন্য। তখন আমি আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ ওর উপর নির্ভরশীল, আমি যে একটি নিপীড়নমূলক বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ- তখনও তা অনুধাবন করতে পারিনি।
কিছু সময় কারাবাসের পর প্রোবেশনে মুক্তি পায় জন। প্রথমে দুজনে মিলে মিশরে যাই, তারপর সেখান থেকে ইস্তাম্বুলে (তুরস্কে) আসি। জন সিরিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু, একটি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সন্তান নিয়ে বসবাসের পক্ষপাতি ছিলাম না আমি মোটেই। এনিয়ে আমার সিদ্ধান্ত ছিল অটল।
উপায়ান্তর না দেখে জন আমাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তার বাবা-মা'কে জানায়, ইস্তাম্বুলে বসবাসের মতো স্বচ্ছলতা না থাকায়, আমরা তুরস্কের আন্তাকিয়া শহরে যাব। কিন্তু, এটা ছিল তার দেওয়া প্রথম বড় ধোঁকা। সে মিথ্যে বলে আমাদের নিয়ে সিরিয়া সীমান্তে গিয়েছিল।
ইস্তাম্বুল থেকে যখন মধ্যরাত্রের বাসে উঠি তখনও জানিনা ঘটনা কী? আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, বাসে উঠেই ঘুমেই পড়ি। ঘুম ভাঙ্গে ভোরবেলা, বাস তখন থেমেছে সিরিয়ার সীমান্তে। আমি যেন বাড়াবাড়ি কিছু না করি, সেজন্য জন আমাকে এক প্রকার শাসিয়েই সতর্ক করলো। সিরিয়ার একটি সীমান্ত চেকপয়েন্টে তখন বাসটির সকলের কাগজপত্র পরীক্ষা করছে সেনা সদস্যরা। চিৎকার করলে হিতে-বিপরীত একটা কিছু হবে, ভেবেই চুপ ছিলাম।
অবশ্য, আমি দমবার পাত্র ছিলাম না, কোনো রকমে একটি ফোন খুঁজে পেতেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে জনের মাকে কল করি। তাকে জানাই, সে মিথ্যে বলে আমাদের সিরিয়া নিয়ে যাচ্ছে। আমি কান্নাকাঁটি করে তাকে বিষয়টি এফবিআই'কে জানানোর অনুরোধ করি। আমি জানতাম এফবিআই দীর্ঘদিন ধরেই জনকে অনুসরণ করছিল।
এফবিআই জনের মাকে জানায়, আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি, তাহলে আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার অভিযোগ তারা আনবে না।
ওদিকে সিরিয়ায় আমার অবস্থা ছিল শোচনীয়। যে বাড়িতে উঠেছিলাম, তার ছাদের পানির ট্যাঙ্কটি গুলিতে শতছিদ্র হয়ে উঠেছিল। পুষ্টির অভাবে আমি ও আমার বাচ্চারা শুকিয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চাদের প্রাণসংশয়ের ঝুঁকি আমাকে সারাক্ষণ উদ্বেগে রাখতো।
এ সময়টা জন আমাকে প্রায়ই এফবিআই গোয়েন্দাদের তার ব্যাপারে জানানোর বিষয়টি নিয়ে দোষারোপ করতো। আমিও বেঁকে বসেছিলাম। নিজের মুখ ঢাকা বাদ দিয়েছিলাম। আমার কারণে সে অন্য (জঙ্গিদের) কাছে লজ্জাবোধ করতো। সে আমাকে বোঝা মনে করা শুরু করেছিল। ওর বন্ধুরা হয় আমাকে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ অথবা তালাক দেওয়ার পরামর্শও দিতে থাকে।
তবে, সবশেষে জন একটু নরম হয়। সে আমাদের যেতে দিতে রাজি হয়। এজন্য অবশ্য আমাকে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব আর লড়াই থামার জন্য আরও তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। একজন আদম পাচারকারীকে আমাদের সীমান্ত পার করে তুরস্কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অর্থ দিয়েছিল জন। এ যাত্রাপথ সহজ ছিল না মোটেই। কয়েক মাইল রাস্তা আমাদের বাধ্য হয়ে দৌড়ে পার হতে হয়। স্নাইপারের নিশানা এড়াতে কখনোবা ট্রাকের তলে ঝাঁপ দিয়ে লুকিয়েছি, কখনোবা টপকেছি তীক্ষ্ম কাঁটাতারের বেড়া।
পাচারকারীর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল সে আমাদের তুরস্কের একটি বাস স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কিন্তু আমাদের অজানা অচেনা এক পথে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় সে। এত কষ্ট করে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর তীরে এসে তরী ডুববে- এভেবেই ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু, ওই সময় দেবদূতের মতো দেখা দিলেন একজন দয়ালু তুর্কি নাগরিক। তিনিই সঠিক রাস্তা দেখালেন।
এভাবে জীবিত থাকতে পেরে, আমার সন্তানদের জীবিত থাকা নিয়ে এবং পরিচিত পৃথিবীর কাছে ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে আমি দারুণ কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছিলাম।
ওদিকে আমার স্বামী জন তখন ব্যস্ত তার যুদ্ধ আর হিংসার জগতে। সে সিরিয়ায় আইএসআইএসের ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পশ্চিম থেকে আসা অন্য যুবকদের কট্টরপন্থি আদর্শে দীক্ষা দেয় জন। ওর সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি। এর মধ্যে সে সিরিয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল বলেও শুনেছিলাম।
গতবছর ওর মৃত্যুর কথা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে সিরিয়ায় মার্কিন বোমা হামলার সময়ে ওর মৃত্যু হয়।
আর আমি এখন টেক্সাসে থাকি। আমার বাসস্থান থেকে কয়েক সড়ক পর জনের বাবা-মা থাকেন। সন্তানেরা তাদের দাদা-দাদির কাছাকাছি থাকার সুযোগ পাচ্ছে, এনিয়ে আমিও খুব খুশি। আমার বর্তমান স্বামী খুবই যত্নশীল। সে আমাকে সম্মান দেয় এবং মতামতের গুরুত্ব দেয়। নিজের মত থাকার এ স্বাধীনতা আমি সবসময়ই উপভোগ করি।
আমি এখন যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা বিরোধী গ্রুপ ফেইথ ম্যাটার্স- এর সঙ্গে কাজ করছি। কট্টরপন্থা থেকে যুবসমাজকে ফেরাতে হলে, আদের প্রকৃত বাস্তবতার তথ্য দিতে হয়। সেসব ঘটনা উপস্থাপন করতে হয়। বিজ্ঞানের মাধ্যমে যুক্তি উপস্থাপন করতে হয়। এসব অভ্যাস আমাকে পরিবর্তন করেছিল। সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে, আমার পড়ার অভ্যাস, নিজেকে আরও শিক্ষিত করার প্রয়াস। আমি আজ উপলদ্ধি করি, একসাথে শান্তিতে বসবাস করতে হলে সমাজের সকলকেই একে-অপরের মূল্যবোধকে সম্মান জানাতে হবে।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান