ইসরায়েল- ফিলিস্তিনি সংঘাত: পুরোনো ক্ষত যেখানে নতুন লড়াইয়ের ইন্ধন দিচ্ছে
ইসরায়েলি নাগরিক ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের কারণ অনেক, দীর্ঘদিন ধরে এসব ক্ষত জিইয়ে রাখার ফলেই উভয় জাতির মধ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতাগুলো ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল অঞ্চলের বুকে সবচেয়ে দগদগে এই 'ঘা' ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের লড়াই, জাতিগত ট্র্যাজেডি আর ঘৃণার ইতিহাস। একারণেই, মুখোমুখি সহিংস হাতাহাতি থেকে আল আকসার বিক্ষোভ শেষপর্যন্ত রূপ নিয়েছে রকেট নিক্ষেপ ও যুদ্ধবিমানের হামলায়, ফলে বাড়ছেই নিহতের সাড়ি।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে পশ্চিমা দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের খবর তেমন করে শিরোনামে ঠাই পায়নি , কিন্তু তাই বলে এর সমাপ্তি ঘটেছে তেমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। উত্তেজনার উপলক্ষগুলো প্রশমিত হয়নি, তাই কমেনি ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কয়েক প্রজন্মের শত্রুতা ও রক্তারক্তির যন্ত্রণা থেকে তৈরি হওয়া এমন মনোভাব দূর হওয়ার কথাও নয়।
জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত এক শতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র যে দখলীকৃত ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার নিয়ন্ত্রণের লড়াই করেছে আরব ও ইহুদিরা। ১৯৪৮ সালের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট থেকে স্বাধীনতার পর ইসরায়েল একাধিক বড় আকারের যুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন এবং তাদের তৎকালীন আরব মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কিন্তু, তারপরও চূড়ান্ত জয় লাভ করতে পারছে না।
সহিংসতার এই ধারা চলতে থাকলে উভয় পক্ষের কেউই নিরাপদ থাকতে পারবে না। তার মাধ্যমে শুধু কয়েক বছর পর পর বড় ধরনের মারাত্মক ও হিংস্র সঙ্কট উদ্ভবের পরিণতিটাই নিশ্চিত সম্ভাবনা। সেজন্যই গত ১৫ বছর ধরে গাজা ও ইসরায়েলকে বিভাজনকারী সীমান্ত জুড়ে সংঘাত দানা বাঁধতে দেখা যায়।
কিন্তু, এবার পবিত্র নগরী জেরুজালেম এবং তার ধর্মীয় স্থানগুলোয় ঘটে চলা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যে মারাত্মক সংঘাত সৃষ্টির শক্তি রাখে, সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের জন্য জেরুজালেমের পবিত্রতা শুধু ধর্মীয় ইস্যু নয়। শহরটির ইহুদি ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থানগুলো জাতীয় পরিচয়েরও প্রতীক। ভৌগলিক দিক থেকেও সেগুলোর অবস্থান একেবারেই কাছাকাছি। যেমন ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপয়েন্টের কাছেই অবস্থিত ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানদের জন্য অতি-পবিত্র হোলি সেফলকার গির্জা। তারা বিশ্বাস করেন যিশুর মৃত্যুর পর এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে এবং এখান থেকেই তিঁনি পুনঃআবির্ভূত হবেন।
অধিকৃত জেরুজালেম থেকে বিশেষ করে নগরীর প্রাচীন অংশ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরে বসবাস করে আসা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। প্রাচীন অংশের দেওয়াল ঘেঁষা ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত মহল্লা শেখ জাররাহ-তে উচ্ছেদ অভিযানই সাম্প্রতিক অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ উস্কে দেয়। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা এই এলাকার ভূমি ও সম্পত্তি ইসরায়েলি আদালতে তাদের নিজেদের মালিকানায় থাকার দাবি করেছে।
এই বিরোধ শুধু কিছু বাড়ির দখল ঘিরে মনে করলে ভুল বলা হয়। জেরুজালেমকে শুধু ইহুদি অধ্যুষিত শহরে পরিণত করার চেষ্টা ইসরায়েলের সকল সরকারই চালিয়ে আসছে, শেখ জাররাহ-ও তারই অংশ। পুরোনো ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উদ্বাস্তু বানিয়ে ফেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেরুজালেমের চারপাশের দখলীকৃত জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে বৃহৎ সব ইহুদি বসতি। আর বিগত কয়েক বছরে 'ওল্ড সিটি'খ্যাত শহরের প্রাচীন অংশের ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের একের পর এক বাড়ি থেকে উৎখাত করে ইহুদি ইসরায়েলিদের সেখানে আবাসন গড়ে দিতে তৎপর রয়েছে ইসরায়েলি সরকার ও বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠীসমূহ।
এই বঞ্চণার সঙ্গে যোগ হয় পবিত্র রমজান মাস জুড়ে শহরের ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি পুলিশের কঠোর আচরণ। তারা মক্কা ও মদিনার পর ইসলাম ধর্মের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসায় সিএস গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
এসময় হামাস উল্লেখযোগ্য এক পদক্ষেপ নিয়ে ইসরায়েলের প্রতি আল আকসা কম্পাউন্ড এবং শেখ জাররাহ থেকে তাদের সকল বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা দিয়ে বেঁধে দেয়, ইসরায়লে তাতে কান না দিলে জেরুজালেম লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায় তারা।
সঙ্গেসঙ্গেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক টুইট বার্তায় বলেন, " গাজার সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। ইসরায়েল এবার চরম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জবাব দেবে।"
এই ঘটনাগুলো পরস্পর অন্যভাবে ঘটলেও হয়তো ফলাফল একই হতো। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যেকার বিরোধের ইস্যুগুলোর সমাধান না হলে, হিংসার এই চক্র পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা বেড়ে চলার সময়েই বেশ বোঝা যাচ্ছিল, অতীতে যেমন উভয়পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আপোষ করেনি, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। অতীতেও উভয়েই অনমনীয় আচরণ করেছে। আমি নিজেও ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জেরুজালেমে টানা বাস করেছি, সেখান থেকে চলে আসার পরও বহুবার যাওয়া হয়েছে। শেষ কবে উভয়পক্ষ আপোষের মনোভাব দেখিয়েছিল, তবু সেই প্রশ্নের সন্ধান করতে থাকি স্মৃতির গলিতে।
উত্তর পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু, যতদূর মনে পড়ে ১৯৯০ এর দশকে অসলো শান্তি প্রক্তিয়ার সর্বোচ্চ সময়ে আশাজ্বল এক মুহূর্ত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু, ওই সময়ের আনন্দ অনুভূতির কথা জেরুজালেমে দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বাসকারী ৪০ বছরোর্ধ ফিলিস্তিনিরা ভালো বলতে পারবেন।
ফিলিস্তিনি বা ইসরায়েলি যেকোনো নেতার উচিৎ ছিল শান্তি স্থাপনের চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা; তা না করে উভয়পক্ষের রাজনীতিকরা আজ নিজেদের যার যার অবস্থান দৃঢ় করার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির লড়াইয়ে ব্যস্ত। ফলে সেই চ্যালেঞ্জ আজ বহুবছর ধরে অবহেলিত।
এরমধ্যেই শান্তি স্থাপনের কিছু নতুন ধারণা জন্ম নিয়েছে। কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এবং ইউএস/ মিডল ইস্ট প্রজেক্ট নামের দুটি মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সম্প্রতি প্রকাশ করে তাদের এক যৌথ প্রতিবেদন। সংস্থা দুটি ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি উভয় জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠাকে প্রথম গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করে।
প্রতিবেদনেটি বলছে, "ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকলের জন্য সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে। দুটি পৃথক এবং অসম ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উচিৎ হবে না।"
এমন নতুন ভাবনাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু, চলতি সপ্তাহে পুরোনো বাস্তবতা, হুমকি পাল্টা হুমকির ছন্দ এবং শতাব্দী প্রাচীন সংঘাতের সর্বশেষ বিস্ফোরণ যেকোনো সমাধানের আশাকে আরও অতলে তলিয়ে দিচ্ছে।
- সূত্র: বিবিসি