ইসরায়েল সরকারের ইন্ধনে আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিক্রি করেছে এনএসও!
সৌদি আরব ও ইসরায়েল যে ধর্মীয় দিক থেকে শত্রু, ২০১৭ সালে এ কথা একবাক্যে মেনে নিত সবাই। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। তারপরও কয়েকজন ইসরায়েলি ব্যবসায়ী সে বছরের গ্রীষ্মে ভিয়েনা, সাইপ্রাস ও রিয়াদে সৌদি কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন সভা করেন। সেটা ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত।
ইসরায়েলি ব্যবসায়ীরা ছিলেন এনএসও গ্রুপের প্রতিনিধি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সৌদির কাছে এনএসওর অস্ত্র, স্পাইওয়্যার সিস্টেম পেগাসাস বিক্রি করা।
২০১৭ সালের সাইপ্রাসে হওয়া সেই সভায় হাজির থাকা এক ব্যক্তি দ্য গার্ডিয়ানকে জানান, সৌদির এক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা পেগাসাস দেখে 'তাজ্জব' হয়ে গিয়েছিলেন। ওই সৌদি গুপ্তচরের আইফোন হ্যাক করে দেখানো হয় পেগাসাস দিয়ে কীভাবে দূর থেকে ফোনের ক্যামেরাসহ অন্যান্য ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
শত্রুদের জব্দ করার জন্য এমন একটা অস্ত্র পেয়ে সৌদি কর্মকর্তারা খুশিতে আটখানা হয়ে উঠেছিলেন।
ইসরায়েল সরকারের অনুমতি সাপেক্ষেই এনএসও গ্রুপ অন্তত ৫৫ মিলিয়ন ডলারে সৌদি আরবের কাছে ওই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে। সত্যি বলতে, ইসরায়েল সরকারই এনএসওকে উৎসাহ জুগিয়েছিল সৌদির কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করতে।
ইসরায়েল এখন ব্যবসার মাধ্যমে কূটনীতি করার নীতিতে এগোচ্ছে। আগে ব্যবসা, তারপর কূটনীতি। কারও সঙ্গে ব্যবসা করলে, তার সঙ্গে কূটনীতি করার হাজারটা দরজা খুলে যায়। এই হলো ইসরায়লের মূলনীতি।
ইসরায়েলের সাবেক সাইবার-ইন্টিলিজেন্সে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এনএসও।
কিন্তু সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আজারবাইজান ও অন্য কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো এনএসওর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ফোনে আড়ি পেতেছে, তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর প্রবল চাপে পড়েছে ইসরায়েল। এ ঘটনা দেশটিকে কূটনৈতিক চাপে ফেলে দিয়েছে।
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল এনএসওর স্পাইওয়্যার ব্যবহার করছে কি না, সে প্রশ্নও উঠে গেছে সর্বমহলে। অভিযোগ উঠেছে, অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে সফটওয়্যারটি বিক্রি করে তার ফায়দা লুটেছে ইসরায়েল।
যদিও এনএসও গ্রুপের দাবি, কঠোর পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার পরই কেবল কোনো গ্রাহকের কাছে স্পাইওয়্যারটি বিক্রি করে তারা। তাদের দাবি, মানবাধিকার লঙ্ঘন করার ঝুঁকি আছে, এমন গ্রাহকের কাছে নজরদারি করার প্রযুক্তি বিক্রির অনুমতি তাদেরকে দেয় না ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
কোনো দেশের কাছে আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিক্রি করা হবে কি না, তা নির্ধারণের জন্য ইসরায়েল যে মানদণ্ড ব্যবহার করে, তাকে এনএসও 'রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা' হিসেবে বিবেচনা করে।
গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর, ২০১৮ সালে এনএসও কয়েক মাসের জন্য সৌদি আরবের পেগাসাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে ইসরায়েল সরকারের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে সৌদি আরব ফের স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
ইসরায়েল সরকার কেন রিয়াদকে পেগাসাস সংযোগ ফিরিয়ে দিতে এনএসওকে অনুরোধ করেছিল, তা স্পষ্ট নয়।
তবে পেগাসাস প্রজেক্টের আওতায় করা ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রযুক্তিটির অপব্যবহার করা যে ১০টি দেশের নাম উঠে এসেছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক অথবা ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে।
ধারণা করা হচ্ছে, ভারত ও হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীরা ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর থেকেই দেশ দুটি পেগাসাস ব্যবহার শুরু করে। জানা গেছে, ইসরায়েলের শত্রু বলে পরিচিত কোনো দেশ—যেমন তুরস্ককে—এনএসওর প্রযুক্তি দেওয়া হয়নি।
২০১৭ সালে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তখন সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, তিনি সাইবার সিকিউরিটির ব্যাপারে নাক গলান।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এনএসওর কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা—যেমন, প্রতিষ্ঠানটির স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে জোগাড় করা তথ্য দেখার অধিকার—পায় কি না, তা জানা যায়নি। কোম্পানিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, আমেরিকার সন্দেহ—এনএসওর গ্রাহকরা যেসব তথ্য জোগাড় করে, তা দেখে ইসরায়েল।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাবের গবেষক জন স্কট রেইলটন বলেছেন, নথিপত্র থেকে জানা গেছে, নজরদারি করার জন্য গ্রাহকের দেশের বাইরের সার্ভারও ব্যবহার করেছে এনএসও।
এনএসও অবশ্য দৃঢ়ভাবে দাবি করেছে, তাদের গ্রাহকদের সিস্টেমে ইসরায়েল সরকারের প্রবেশাধিকার নেই। প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী বলেন, "এনএসও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি 'ইসরায়েলের কূটনীতির' অস্ত্র নয়, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন দরজাও নয়। প্রতিষ্ঠানটি কোনো সরকারি নেতার কাছ থেকেই কোনো ধরনের নির্দেশনা নেয় না।"
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও দাবি করেছে, এনএসওর গ্রাহকদের সংগ্রহ করা তথ্যে ইসরায়েল সরকারের প্রবেশাধিকার নেই।
পেগাসাস ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে যেসব গ্রাহক, তাদের মধ্যে সৌদি আরবই ইসরায়েলকে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় ফেলেছে। আল জাজিরার কয়েক ডজন সাংবাদিকের ফোন হ্যাক করার অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ আগে দ্বিতীয়বারের মতো সৌদি আরবের পেগাসাস সংযোগ কেটে দেয় এনএসও।
সৌদি আরব এ বাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
-
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান