এবার গবেষণায় উচ্চ কার্যকারিতা দেখিয়েছে চীনা সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন
চীনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে শুরু থেকে এক ধরনের সংশয় ছিল। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পশ্চিমা দেশগুলোয় উৎপাদিত ভ্যাকসিনের চাইতে অনেকগুণ কম কার্যকরী প্রমাণিত হওয়ায় চীনা ভ্যাকসিন কিনতে দোনোমনা করছিল উন্নয়নশীল দেশগুলো। কিন্তু এই মুহূর্তে চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দিয়েই নিজেদের দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে টিকাদান কর্মসূচি চালাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ২৫,৩৭৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে চীনা ভ্যাকসিন দেয়ার ২৮ দিন পর আবার পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ভ্যাকসিনটি মৃত্যুহার কমাতে শতভাগ কার্যকারিতা দেখিয়েছে এবং সাতদিন পরেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে দূরে রাখতে ৯৬ শতাংশ কার্যকরী হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুদি গুনাদি সাদিকিন গতকাল মঙ্গলবার এই তথ্য দেন। ইন্দোনেশিয়ায় এই সফলতার ফলে চীনা ভ্যাকসিনের উপর মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাদিকিন আরো জানিয়েছেন যে, ৯৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মীই সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছেন। এর আগে ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাওয়া ফলাফলের তুলনায় এটি নিঃসন্দেহে চমৎকার ফলপ্রসূ। যদিও এই ফলাফল দেখানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই শুধু সুস্থদের সামনে এনে হাজির করা হয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না।
সাদিকিন বলেন, 'আমরা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মৃত্যু বা হাসপাতালে নেয়ার হার অতিমাত্রায় কমে যেতে দেখেছি। তবে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন ইন্দোনেশিয়ায় ভাইরাসের ঠিক কোন স্ট্রেইনের (প্রকরণ) বিরুদ্ধে কাজ করেছে তা আমরা জানিনা। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ কোনো ভ্যারিয়েন্টের দ্বারা চরম সংক্রমণ এখনো দেখা যায়নি।'
সিনোভ্যাক এর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ও ডেটা সংক্রান্ত স্বচ্ছতা নিয়ে আগে প্রশ্ন উঠলেও, ব্রাজিলেও জনসাধারণের মধ্যে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেখা গেছে। এর আগে ব্রাজিলে তাদের তৃতীয় মাত্রার সবচেয়ে বড় ট্রায়াল, 'করোনাভ্যাক' বলে যা পরিচিত, তাতে এটির কার্যকারিতার হার দেখা গিয়েছিল মাত্র ৫০ শতাংশের কিছু বেশি।
তবে বেইজিং এ সিনোভ্যাকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার আগপর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না।
গেল মঙ্গলবার ব্লুমবার্গের সঙ্গে এক আলাদা সাক্ষাতকারে সিনোভ্যাক-এর প্রধান কার্যনির্বাহী, ইন ওয়াইডং দাবি করেছেন যে তাদের ক্লিনিক্যাল ডেটায় কোনো অস্বচ্ছতা ছিলনা। বরং বাস্তব ক্ষেত্রে যখন প্রয়োগ করা হয়েছে, করোনাভ্যাক তখন আরো ভালো কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
কিন্তু সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পেতে হলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে একসাথে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করতে হবে যা উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর অবকাঠামোতে দ্রুত সম্পাদন করা সম্ভব নয়। ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং ব্রাজিলের সেরানা শহরে ৪৫,০০০ মানুষকে নিয়ে যে গবেষণা করা হয় এবং সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা পাওয়া যায়- তাতে এ দুই জায়গায়ই একটি বিশাল জনসংখ্যাকে পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে চিলি তাদের ১৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশকে ভ্যাকসিন দিয়েছিল, যা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রততর একটি টিকাদান কর্মসূচি ছিল। কিন্তু তবুও লাতিন আমেরিকায় ছড়াতে থাকা ভয়াবহ ভ্যারিয়েন্টের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তারা। টিকাদানের পরেও চিলিতে মারাত্মক করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়।
চিলিতে প্রথম দিকে শুধু বৃদ্ধদের টিকা দেয়া হয়েছিল বেশি। কিন্তু তরুণরা ভ্যাকসিন না পাওয়ায় এবং বাইরে নানা কাজ করতে যাওয়ায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। চিলিতে করোনাভ্যাক টিকা নেয়াদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ মানুষ মারাত্মক কোভিড সংক্রমণ থেকে রেহাই পেয়েছে।
সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা স্থানভেদে আলাদা আলাদা হতে পারে, কিন্তু নতুন নতুন মিউটেশনের ক্ষেত্রে এটি খুব ভাল কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি বলে জানান ইন।
তবে সবগুলো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই মূল প্রশ্ন একটিই যে এসব ভ্যাকসিন কি করোনা প্রতিরোধ করবে নাকি সংক্রমণকে বাধা দিবে?
মঙ্গলবার ইন জানান, সিনোভ্যাক এখনো জানেনা যে তাদের ভ্যাকসিন ভাইরাসকে থামাতে বা একেবারে কমিয়ে আনতে পারবে কিনা, কিন্তু এটি ভাইরাস সম্পর্কিত গুরুতর রোগ ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে।
বায়োটেক এসই এবং ফাইজারের উৎপাদিত এমআরএনএ-যুক্ত ভ্যাকসিন ইসরায়েলে ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে এমআরএনএ-বিহীন ভ্যাকসিনগুলো সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করছে। সিনোভ্যাকের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়ায় তা চীনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা পেলে তাদের ভ্যাকসিনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়বে এবং বিক্রিও বাড়বে।