কঠোর শর্ত আরোপের সিদ্ধান্তে বিপাকে মালেশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ ভিসাধারী বাংলাদেশিরা
অবসরের পর বাকি জীবন মালেশিয়ায় কাটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন বাংলাদেশের মনসুর ও মইনা খান। ২০১৪ সালে তারা দীর্ঘমেয়াদী এমএম২এইচ (মালেশিয়া মাই সেকন্ড হোম) ভিসা পান। ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রিঙ্গিতে রাজধানী কুয়ালালামপুরের প্রাণকেন্দ্রে একটি কন্ডোমিনিয়াম অ্যাপার্টমেন্ট কিনে সেখানে স্থায়ী হন এই ষাটোর্ধ্ব দম্পতি।
"আমাদের জীবনের সকল সঞ্চয় আমরা মালেশিয়ায় বিনিয়োগ করেছি," বলেন মনসুর খান।
"আমরা মালেশিয়া থাকতে ভালোবাসি। এখানে বিভিন্ন জাতির মানুষের সমন্বয় ঘটেছে, রয়েছে ভিন্ন স্বাদের সব খাবার। আমরা আইন-মান্যকারী ভিসাধারী এবং ঝামেলা মুক্তভাবে মালেশিয়ায় অবসর জীবন কাটাতে চাই," বলেন তিনি।
কিন্তু পারিবারিক জরুরি কাজে ঢাকায় এসে আটকে যান এই দম্পতি। গত ১৪ মাস ধরে তারা ঢাকায় রয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ ভ্যাকসিন গ্রহণের পর ইমিগ্রেশন বিভাগে অসংখ্য আবেদন করা সত্ত্বেও মালেশিয়ায় ফিরতে পারেননি তারা। কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশসহ ২৩টি দেশের ওপর মালেশিয়া ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ভোগান্তির শিকার হন মনসুর ও মইনা খান।
এসব দেশ থেকে মালেশিয়ান নাগরিকরা ফিরতে পারলেও খান দম্পতির মতো এমএম২এইচ ভিসাধারীরা ঘরে ফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গত সপ্তাহে পুনঃমূল্যায়নের ভিত্তিতে 'মালেশিয়া মাই সেকেন্ড হোম' ভিসায় পরিবর্তন আনে মালেশিয়া সরকার। ভিসাধারীদের ওপর কঠোর সব শর্ত আরোপের ফলে মনসুর ও মইনা খানের মতো দীর্ঘমেয়াদী এই ভিসাধারী অসংখ্য মানুষের পরিকল্পনা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
প্রায় এক বছর ধরে এমএম২এইচ ভিসা প্রদান বন্ধ রাখার পর আগামী অক্টোবর থেকে নতুন সব শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে ভিসা কার্যক্রম শুরু হতে চলেছে। ১০ বছরের পরিবর্তে এখন থেকে মাত্র পাঁচ বছর মেয়াদী ভিসা মিলবে। এছাড়া, ভিসা অর্জনের ন্যূনতম আয়ের সীমাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নতুন নিয়ম অনুসারে, ভিসার জন্য বিদেশিদের অন্তত ১৫ লাখ রিঙ্গিতের সমপরিমাণ তরল সম্পদ থাকতে হবে। এর আগে, পঞ্চাশোর্ধ্বদের জন্য ন্যূনতম তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে তিন লাখ রিঙ্গিত এবং ৫০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ রিঙ্গিতের সমপরিমাণ তরল সম্পদই যথেষ্ট ছিল। তবে, এই পাঁচ লাখ অর্থ বাড়ি ও জমি, স্বাস্থ্যসেবা ও স্কুল খরচে ব্যবহার করা যেত।
এছাড়া, এখন থেকে ভিসা পেতে ন্যূনতম মাসিক আয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার রিঙ্গিত। পূর্বে ন্যূনতম মাসিক আয়ের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার রিঙ্গিত।
মালেশিয়া সরকার জানায় তারা উচ্চ আয়ের মানুষদের টানতেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কোভিড-১৯ মহামারি ও চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে রক্ষা করতে দেশে ধনীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে মালেশিয়া সরকার।
তবে, হটকারী এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে বর্তমান ভিসাধারীরা। ভিসা নবায়নের ক্ষেত্রে এই নতুন শর্ত পূরণ করা তাদের জন্য কঠিন হবে বলে মন্তব্য করছেন তারা। সরকার নতুন শর্ত পূরণে তাদের এক বছর পর্যন্ত সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টি সহজ বলে মনে করছেন না এমএম২এইচ ভিসাধারীরা।
নবায়ন জটিলতা
২০০২ সালে শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত এমএম২এইচ ভিসা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৪৯ হাজার মানুষকে এই ভিসা প্রদান করা হয়। এদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চীন থেকে আগত। অন্যদিকে, ১০ শতাংশ রয়েছেন জাপানের অধিবাসী। নয় শতাংশ মানুষ নিয়ে ভিসাধারীদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সাড়ে তিন শতাংশ ভিসাধারীরা এসেছেন হংকং থেকে।
বর্তমান ভিসাধারীদের মূল অভিযোগ হলো মালেশিয়া সরকার নবায়নের ক্ষেত্রেও পরিবর্তিত শর্তের বিধান রাখতে চলেছে। ভিসা আবেদনের সময় বহু আবেদনকারীই ভেবেছিলেন দশ বছর পরেও নবায়ন শর্ত একই রকম থাকবে।
এছাড়া, মূল আবেদনকারীর মৃত্যু হলে শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই নির্ভরশীলদের নতুন শর্তের অধীনে পুনরায় নতুন করে যাচাই প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে জানান ভিসা এজেন্টরা।
সিঙ্গাপুর থেকে আগত এমএম২এইচ ভিসাধারী ন্যান্সি জানান, তিনি গত ১০ বছরে মালেশিয়ায় লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন।
"আমরা মন্ট কিয়ারায় দুটো বাড়ি কিনেছি, দুটো গাড়িও আছে। দুই সন্তানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ফি দিয়েছি। করও প্রদান করেছি আমরা। বাড়ির বয়স্ক দম্পতি শীঘ্রই স্বাস্থ্য পরিষেবাও গ্রহণ করবেন। এত সব ফেলে কেন যাব আমরা?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
মালেশিয়া সরকারকে ভিসা কর্মসূচি পুনঃমূল্যায়নের আহ্বানও জানান ন্যান্সি।
রিয়েল এস্টেট বাজারে প্রভাব
সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় ও এমএম২এইচ ভিসা সংক্রান্ত স্থানীয় পরামর্শদাতাদের মতে, কঠোর শর্ত আরোপের ফলে ভিসা আবেদনের সংখ্যা কমবে। একইসঙ্গে, বিদ্যমান ভিসাধারীরাও কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসে সম্পত্তি বিক্রি করার দিকে ঝুঁকবেন বলে ধারণা করছেন তারা। ফলে, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে না বলেই তাদের ধারণা।
"মালেশিয়া আমাদের একমাত্র ঘর," বলেন মনসুর খান। "বৈধ ভিসা ও সকল বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে আমরা মালেশিয়া যেতে রাজি থাকলেও গত ১৪ মাস যাবৎ অস্থায়ীভাবে ঢাকায় বাস করছি। মালেশিয়ায় আমাদের সম্পত্তি বিনা নজরদারিতে পড়ে রয়েছে। জীবনের এই সন্ধিক্ষণে মানসিক ও আর্থিক অসহায়ত্ব আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে," বলেন তিনি।
"আমাদের মতো ভোগান্তির শিকার ভিসাধারীরা যদি এই কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসে এবং আমরা যদি ২০২৪ সালে ভিসা নবায়ন না করাই, তবে কি তা অযৌক্তিক হবে?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
মালেশিয়ার রিয়েল এস্টেট প্র্যাকটিশনার অ্যাসোসিয়েশনও (এমআইইএ) উচ্চহারের ফিক্সড ডিপোজিট, তরল সম্পদ ও ন্যূনতম আয়ের সীমা বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটি বিভিন্ন ধারার আবেদনকারীর কথা মাথায় রেখে ভিসা পরিকল্পনার কথা জানায়।
নতুন শর্তসমূহের বেড়াজালে বর্তমান ভিসাধারীদের না জড়ানোর আহ্বানও জানিয়েছে তারা। এছাড়া, ভিসার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত রাখার দাবি করে এমআইইএ।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলে, "আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ভিসা নীতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন।"
"বর্তমান ভিসাধারীদের নতুন শর্তের আওতায় না আনার প্রস্তাব রাখছি আমরা। কেননা, ভিসা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের আমাদের প্রতি আস্থা ও শুভকামনা রয়েছে," জানায় সংস্থাটি।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট