কারা আইসিস-কে (আইসিস খোরাসান)
ইসলামিক স্টেট-খোরাসান বা আইসিস-কে (ISIS-K) নামে পরিচিত গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন কর্মী ও নাগরিকদের উপর হামলার পরিকল্পনা করে আসছিলো। মূলত এ কারণেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন চেয়েছিলেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা সীমিত করতে।
বৃহস্পতিবার, ইসলামিক স্টেটের এই আঞ্চলিক শাখা কাবুলের প্রাণকেন্দ্র হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে এবং ব্যারন হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় কমপক্ষে ১২ জন আফগান বেসামরিক মানুষ এবং ১৩ জন মার্কিন কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে।
বিস্ফোরণ ঘটানোর পরপরই দলটি এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
আইসিস-এর দক্ষিণ এশিয় সহযোগী শাখা আইসিস-খোরাসান বা আইসিস-কে সম্পর্কে এবারে জেনে নেওয়া যাক।
ইসলামিক স্টেট-এর অধিভুক্তি হওয়ার অর্থ
২০১৪ সালে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আইএস-কে এর আবির্ভাব হয়। তখন থেকেই এই গোষ্ঠী আইসিসের সহযোগী বা একটি অধিভুক্ত শাখা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
আফগান তালেবান এবং পাকিস্তান তালেবান থেকে বের হয়ে এসেছে, এমন কিছু সদস্যের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইএস-কে।
বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশেই আইসিস তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। পাকিস্তান ও আফগান তালেবানদের মধ্য থেকে কিছু অসন্তুষ্ট সদস্যদেরকে আইএস প্রতিনিধিরা নতুন এই জঙ্গি গোষ্ঠী গঠনে উৎসাহ দেয়। আর এভাবেই গড়ে ওঠে আইসিসের খোরাসান শাখা।
২০১৫ সালে এক ভিডিও বার্তায়, সেই সময় দলের নেতা হাফিজ সাইদ খান এবং অন্যান্য শীর্ষ কমান্ডাররা ইসলামিক স্টেটের তৎকালীন নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং নিজেদেরকে আফগানিস্তানে নতুন আইসিস অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশনের তথ্য অনুসারে, আঞ্চলিক এই শাখা ইসলামিক আইনের কঠোর ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের দখল করা অঞ্চল পরিচালনা করে থাকে। কঠোর নিয়ম নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড, উপজাতীয় প্রবীণদের হত্যা এবং স্কুল করা সহ আরও নানা ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ড।
২০১৬ সালে মার্কিন বাহিনীর এক ড্রোন হামলায় হফিজ সাইদ খান নিহত হন এবং এর তিন বছর পর, ২০১৯ সালে মার্কিন বাহিনীর অভিযানের সময় একটি বিস্ফোরক জ্যাকেট পরে বাগদাদি আত্মহুতি দেয়।
ইসলামিক স্টেট ও তালেবান গোষ্ঠীর সম্পর্ক
বৃহস্পতিবার এক টেলিভিশন ভাষণে বাইডেন বলেছেন, আইএস-কে এবং তালেবান গোষ্ঠী মূলত পরস্পরের শত্রু। প্রতিষ্ঠান পর থেকেই তালেবান এবং আইএস-কে'র মাঝে নানা বিষয় নিয়ে রয়েছে মতভেদ।
দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশলান স্টাডিজ-এর গবেষক সেথ জোনস বলেন, "তাদের মূল লক্ষ্য হলো, একটি ইসলামী আমিরাত তৈরি করা এবং এক্ষেত্রে তারা আল-কায়েদা এবং তালেবান উভয়েরই প্রতিদ্বন্দ্বী।"
অনেক তালেবান সদস্য ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়ার জন্য দলত্যাগ করেছে, এবং এই দুই দলের মাঝে সম্পদ এবং ভূখণ্ডের দখল নিয়ে রয়েছে বড় ধরণের দ্বন্দ্ব।
স্ট্যানফোর্ড সেন্টারের মতে, তাদের মাঝে আদর্শগত মতপার্থক্যও রয়েছে।
মতাদর্শগত পার্থক্য এবং সম্পদ দখলের প্রতিযোগিতা উভয়ই এ দুই গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতার অন্যতম প্রধান কারণ। আইএস-এর অভিযোগ, তালেবান গোষ্ঠী একটি সর্বজনীন ইসলামী মতবাদের পরিবর্তে সংকীর্ণ জাতিগত ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরের বাইরে হামলার ঘটনায় তালেবান গোষ্ঠী নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এমন জায়গায় হামলাটি হয়েছে যে জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
আফগানিস্তানে আইসিস-কে কত বড় হুমকি?
২০১৭ সালের তথ্যমতে, মার্কিন বাহিনী দাবি করে তারা আইসিসের প্রায় ৭৫ শতাংশ সদস্যকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের নেতাও ছিলেন বেশকিছু।
অন্যদিকে, দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশলান স্টাডিজ-এর গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত আইএস-কে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে কমপক্ষে ১০০ টি হামলা চালিয়েছে। এবং মার্কিন, আফগান ও পাকিস্তানের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে এরকম শতাধিক যুদ্ধেও জড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে এখনও কমপক্ষে ২ হাজার সক্রিয় আইএস-কে যোদ্ধা রয়েছে। তবে, যেহেতু দেশ এখন তালেবান দখলে তাই হয়তো খুব দ্রুতই তাদেরকে জায়গা পরিবর্তন করতে হবে।
পেন্টাগনের বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করছেন, আফাগানিস্তানে আইসিস সত্যিই বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং কাবুল বিমানবন্দরে আরও অন্যান্য হুমকিরও আশঙ্কা রয়েছে।
এ বছরের মে মাসে কাবুলে মেয়েদের স্কুলের হামলার দায় সহ আরও অনেকগুলো হাই-প্রোফাইল্ড হামলার দায় স্বীকার করেছে দলটি।
তবে, বৃহস্পতিবারের এই হামলার পর এখন অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই হামলা তালেবান গোষ্ঠীর ক্ষমতার দুর্বলতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
জোনস বলে, "এই ঘটনা বুঝিয়ে দিলো তালেবানের গোয়েন্দা সক্ষমতা এবং সন্ত্রাস দমন ক্ষমতা আসলেই সীমিত। তারা এই হামলার পূর্বাভাসও পায়নি এবং এটিকে ঠেকাতেও পারেনি।"
- সূত্র: এনপিআর