কারা পাবে প্রথম ভ্যাকসিন, কেমন হচ্ছে বিতরণ পরিকল্পনা
মানব ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে তৈরি করা হচ্ছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা। উন্নত কিছু দেশের প্রার্থী টিকার গবেষণা এখন তৃতীয় বা সর্বশেষ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাব মানবদেহে প্রয়োগ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রচেষ্টায় একাধিক টিকা তৈরির গবেষণা এগিয়ে যাচ্ছে দেশটিতে।
এ অবস্থায় আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে বাজারে টিকা চলে আসবে, এমন আশ্বাস দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাস লাগুক, বা সপ্তাহ স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন অনুমোদিত টিকা অচিরেই আসছে। মহামারি যখন লাখ লাখ জনতার বিপন্ন করেছে, তখন সেই আশায় পথ চেয়ে আছেন সকলে।
প্রথমদিকে বাজারে আসা টিকার ডোজের সংখ্যা অবশ্য খুবই কম হবে প্রয়োজনের তুলনায় । কারণ, ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতেও কিছুটা সময় দরকার। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে কাদের প্রথম টিকার আওতায় আনতে হবে, দুরারোগ্য রোগে ভোগা বয়স্ক ব্যক্তিদের?- যাদের কিনা বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং প্রাণহানির ঝুঁকি রয়েছে । নাকি স্বাস্থ্য কর্মীদের?- যারা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের সেবা করে চলেছেন।
বিশ্বের প্রথম গণহারে কোভিড টিকা কর্মসূচী শুরু হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। তখন স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ, চিকিৎসক এবং ওষুধ বিক্রয়কারী সংস্থা সকলকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিতরণ সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। এ পদক্ষেপ সম্পর্কে জেনে রাখা দরকার, কারণ বাংলাদেশ-সহ উন্নয়নশীল দেশে মডেলটির অনুকরণের চেষ্টা করা যেতে পারে। তাছাড়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের সুপারিশ আমলে নিয়েছে।
তবে ভুলে গেলে চলবে না, সার্স কোভ-২ জীবাণু মোকাবিলায় সফল ও নিরাপদ টিকা বাজারে আসলেই বিতরণ কর্মসূচী ব্যাপক আকারে শুরু করা উচিৎ।
বিশেষজ্ঞরা এর উপর অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা বলছেন, কোনো টিকা না থাকার চাইতেও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে একটি ব্যর্থ ও অনিরাপদ টিকা।
আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই একটি ভ্যাকসিন বাজারে আনার তোরজোড় করছেন ট্রাম্প। কিন্তু, এত দ্রুতগতিতে আনা প্রতিষেধক নিতে অনেক মার্কিন নাগরিকই অনিরাপদ বোধ করবেন, অর্থাৎ তা মানুষের আস্থা অর্জনে খুব একটা সফল হবে না। এমন কথাই বলেছেন মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য সম্পদ গবেষণা কেন্দ্রের মানব আচরণ বিষয়ক বিজ্ঞানী সান্ড্রা ক্রুজ কুইন। তার মতে এতে বিতরণ পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের আদলে:
চলতি সপ্তাহেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি কৌশলগত পরামর্শক গ্রুপ করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বিতরণের বৈশ্বিক গাইডলাইনের প্রাথমিক একটি সংস্করণ তৈরির কাজ শুরু করেছে। এর আওতায় যেসব জনসমষ্টিকে আগে টিকার আওতায় আনা দরকার- তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
চলতি মাসের শুরু দিকে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একডেমিস অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিন (নাসেম)-এর বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতেই একটি খসরা পরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে হু'।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় টিকা কর্মসূচীর পরিধিও বাড়াতে হচ্ছে সবখানে। একইসঙ্গে পৃথিবীর সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনার এ পদক্ষেপ মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাছাড়া, নতুন শতকের শুরুতেই এ মহামারি আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতেই আঘাত করেছে। এজন্যে নাসেম-এর পরিকল্পনাটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অন্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে নানা বর্ণ এবং জাতিসত্ত্বার যেসব গোষ্ঠী বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রথমেই টিকার আওতায় আনার সুপারিশ করে নাসেম।
এর ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) খসড়া পরিকল্পনাটি তৈরি করার কাজ চললেও, তা এখন খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দিক-নির্দেশনা হিসেবে জারি করার পূর্বে এতে আরও বিস্তারিত বিষয়াদি যোগ করা হবে।
'টিকা বিতরণের সমস্যা সমাধান নিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর চিন্তা-ভাবনায় জড়িত থাকা খুবই দরকারি' বলছিলেন বাল্টিমোরে অবস্থিত জনস হপকিনস সেন্টার ফর হেলথ সিক্যিউরিটির জরুরি ওষুধ বিষয়ক চিকিৎসক এবং মহামারি বিশেষজ্ঞ এরিক টোনার। হু এবং মার্কিন বিজ্ঞান একাডেমির পরিকল্পনায় কিছুটা অমিল থাকলেও, মিলের পরিমাণটাই বেশি বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ। 'টিকা বিতরণের নানা দিক নিয়ে তাদের মতামতের ঐক্যকে - তিনি একটি চমৎকার অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সবার আগে কারা পাবে?
এই মুহূর্তে যাদের টিকা পাওয়া সবচেয়ে জরুরি এমন জনসমষ্টিগুলোকেই চিহ্নিত করা হচ্ছে হু'র খসড়া দিক-নির্দেশনায়। এক্ষেত্রে নাসেম- এর প্রস্তাবনা এক ধাপ এগিয়ে আছে। সেখানে নানা বয়স ও অর্থনৈতিক শ্রেণির গ্রুপের মধ্যে; কাদের আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার- সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। মার্কিন বিজ্ঞানীরা একটি সারি পরিকল্পনার কথা বলেছেন।
এতে স্বাস্থ্য কর্মীদের পর সবার আগে টিকা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি এমন ব্যক্তিদের। বিশেষ করে, জনঘনত্ব বেশি এমন এলাকায় বসবাসকারী বয়স্কদের এবং আগে থেকেই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের; প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয় নাসেম এর খসড়া পরিকল্পনায়। হৃদযন্ত্রের রোগ এবং যারা ডায়াবিটিসে ভুগছেন টিকায় তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, এসব ব্যক্তির করোনায় সংরক্রমিত হওয়া এবং তাতে প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে অত্যন্ত বেশি।
আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়; গুরুত্বপূর্ণ সব শিল্পের কর্মীদের; যেমন গণপরিবহন ব্যবস্থায় কর্মরতদের। কারণ পেশাগত কারণে তারা বিপুল পরিমাণ লোকের সংস্পর্শে আসেন। তাছাড়া, তুলনামূলক ভিড়ে বসবাসকারী ব্যক্তি; যেমন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী গৃহহীন মানুষেরা বা কারাগারের কয়েদিরা আগেভাগে টিকা পাওয়ার যোগ্য, বলে মনে করছেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা।
সারিভিত্তিক পরিকল্পনা কী:
ইউএস ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনের প্রস্তাব অনুসারে পাঁচ দফায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের করোনাভাইরাস টিকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রত্যকে দফায় আলোচ্য জনসমষ্টির একটি নির্দিষ্ট অংশ টিকার আওতায় আসবেন, যাতে একইসঙ্গে সকলেই তা গুরুত্ব অনুসারে পেতে পারেন।
- প্রথম ধাপ: স্বাস্থ্য এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত অন্যন্য কর্মীদের (৫ শতাংশ)।
- দ্বিতীয় ধাপ: দুরারোগ্য এবং জটিল রোগে আক্রান্তরা এবং জনঘনত্ব বেশি এমন এলাকায় বসবাসকারী বয়স্ক ব্যক্তিরা (১০ শতাংশ)
- তৃতীয় ধাপ: নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবাখাতের কর্মীরা, যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্যান্য কর্মী, গ্রহহীন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী, কয়েদি, জ্যেষ্ঠ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি (৩০-৩৫ শতাংশ)
- চতুর্থ ধাপ: পূর্ণবয়স্ক তরুণ, শিশু এবং জরুরি পণ্য সরবরাহে নিয়োজিত কর্মী (৪০-৪৫ শতাংশ)
- পঞ্চম ধাপ: এই পর্যায়ে গণটিকার আওতায় বাকি ৫ থেকে ১৫ শতাংশ নাগরিককে আনার কথা বলা হয়েছে।
নোট: প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ একটি চক্রের আওতায় পড়বে। অর্থাৎ, টিকাদানের প্রতিটি ভাগে এই দুই পর্যায়ে থাকাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর শতাংশের হিসাব করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ভেতর কতজন টিকা পাবেন, সেই অনুসারে।
- সূত্র: নেচার ডটকম