ইরানী বীর কাসেম সোলেইমানি
বিশ্বব্যাপী এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম কাসেম সোলেইমানি। হত্যার পর থেকেই তাকে নিয়ে তোলপাড় সর্বত্র। বলা হয় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে যার নাম আসে তিনি কাসেম সোলেইমানি।
বিশ্ব গণমাধ্যমেও এখন কাসেম সোলেইমানিকে নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই মেজর জেনারেলকে বলা হচ্ছে ইরানী বীর।
বিবিসির খবরে বলা হয়, ১৯৯৮ সাল থেকে কাসেম সোলেইমানি ইরানের কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইরান রেভোলিউশনারি গার্ডসের এই অভিজাত বাহিনীটি দেশের বাইরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে থাকে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের ইরান সমর্থিত সরকারকে মদদ দেওয়া এবং ইরাকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জেনারেল সোলেইমানি। ১৯৮০ এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘসময় ধরে শত্রুভাবাপন্ন হলেও ইরাকে আইএসর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আদর্শগত দিক বিবেচনায় পরোক্ষভাবে একে অপরকে সহায়তা করেছিল তারা।
১৯৫৭ সালের ১১ মার্চ ইরানের কেরমান প্রদেশের পার্বত্য গ্রামে জন্ম নেন সোলেইমানি। এ এলাকাটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী। তবে মার্কিনরা বলেছে, তার জন্ম ইরানের ধর্মীয় রাজধানী কুওমে।
খুব দরিদ্র পরিবার থেকে অল্প শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন এই সোলেইমানি। তবে ইরানের সবচেয়ে অভিজাত ও শক্তিশালী বাহিনীর ভেতর দিয়েই তার উত্থান ঘটেছিল। এছাড়া দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠও হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সোলেইমানির শৈশব সম্পর্কে বিশদে কিছু জানা যায় না, যদিও ইরানের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সোলেইমানির বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তিনি শাহ মহম্মদ রেজা পহ্লবির কাছ থেকে এক খণ্ড জমি পেলেও পরে দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়েন।
১৩ বছর বয়সে সোলেইমানি নির্মাণ কাজে যুক্ত হন, এর পর কেরমান ওয়াটার অর্গানাইজেশনে চাকরি পান। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। রেভলিউশনারি গার্ড যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন সোলেইমানি তাতে যোগ দেন।
ইরানের উত্তরপশ্চিমে বিপ্লবের পর কুর্দিশ বিদ্রোহ মাথা তুলেছিল যেখানে, সোলেমানের বাহিনীকে সেখানে পাঠানো হয়। এর পরেই ইরানে আক্রমণ করে ইরাক। দু’দেশের মধ্যে ৮ বছর ধরে দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। ইরান যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠায় কিশোর বয়সীদেরও। সোলেইমানির ইউনিট ইরাকি রাসায়নিক অস্ত্রের আক্রমণের মুখেও পড়েছিল।
জেনারেল সোলেইমানি দুই বৈরী ভাবাপন্ন দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও গত কয়েকবছরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে লেবাননের হেজবোল্লাহ অভিযান ও প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামি জিহাদের মত যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন করতে ইরানের 'প্রাথমিক অস্ত্র কুদ'স ফোর্স’। এসব সংগঠনকে তারা অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবান জেনারেল হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীও ছিলেন তিনি।
নিজের দেশে সম্মানিত ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে আতঙ্কবাহী নাম হলেও সোলেইমানি পশ্চিমে ছিলেন প্রায় অপরিচিত। বলা হয়, আজকের ইরানকে পুরোপুরি বুঝতে গেলে আগে কাসেম সোলেইমানিকে জানা দরকার। ওমান উপসাগর থেকে ইরাক, সিরিয়া লেবানন হয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত এলাকা যা ইরানে প্রতিরোধের কেন্দ্র নামে পরিচিত, তার প্রধান ছিলেন এই সোলেইমানি।
১৯৮০-র দশকে সোলেইমানি ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন সোলেইমানি, পরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বৈদেশিক দায়িত্বে থাকা কুদস ফোর্সের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন নিজের হাতে।
২০০৩ সালে ইরানে মার্কিন অনুপ্রবেশের আগে পর্যন্ত সে দেশেও প্রায় অপরিচিতই ছিলেন সোলেইমানি। আমেরিকা তাকে হত্যার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রায় ১৫ বছর পর সোলেইমানি ইরানের সবচেয়ে পরিচিত সামরিক কমান্ডার হয়ে ওঠেন। রাজনীতিতে প্রবেশের ব্যাপারে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। তারপরও ক্ষমতার দিক থেকে বেসামরিক নেতৃত্বের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন।
২০১৮ সালে জানাজানি হয়ে যায় যে ইরাকের সরকার গঠন নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলাপ আলোচনায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে তিনি প্রায়ই বাগদাদ যাতায়াত করতেন, গত মাসেই নয়া সরকার গঠনের ব্যাপারে বিভিন্ন দল তাকে চাইলে ফের বাগদাদ যান তিনি।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ইনস্টাগ্রামে সোলেইমানির ফলোয়ারের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। ২০১৩ সালে সিরিয়ান যুদ্ধে ইরানের ভূমিকাগ্রহণের সময়ে তিনি পাবলিক ফিগার হয়ে ওঠেন। তার ইনস্টাগ্রামে যুদ্ধের ফটো, তথ্যচিত্র, মিউজিক ভিডিও এবং অ্যানিমেটেড ফিল্মও রয়েছে।
সংবাদসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে গত অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ২০০৬ সালে ইজরায়েল-হিজবুল্লা যুদ্ধের সময়ে তিনি গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য লেবাননে গিয়েছিলেন।
২০১৮ সালে ইরানপোল ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সার্ভেতে তিনি ৮৩ শতাংশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, হারিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট হাসান রৌহানি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফকে। লেবাননের হিজবুল্লা ও প্যালেস্টাইনের হামাসসহ যেসব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় সোলেইমানিকে রয়েছেন বলে মনে করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো।