ঘরের ভেতরেও বাতাসে উড়ে বেড়ায় করোনাভাইরাস, আমরা সব জিনিসপত্র কেন ঘষেমেজে রাখব?
করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত হয়ে পড়েছে আকাশপথে চলাচল। প্রায় জনশূন্য হংকং বিমানবন্দরে তারপরও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দল ব্যস্ত ছিলেন ব্যাগেজ ট্রলি, লিফটের বাটন আর চেক-ইন- কাউন্টারগুলো জীবাণুনাশক দিয়ে মোছার কাজে। নিউইয়র্ক শহরে নগর কর্মীরা নিয়মিত বাস, সাবওয়ে স্টেশন আর ট্রেন পরিষ্কার রাখছেন। লন্ডনের অনেক পানশালায় বস্তুর উপরিপৃষ্ঠ পরিষ্কার করা হয় অনেক অর্থ ব্যয় করে।
করোনাভাইরাস ঠেকানোর লক্ষ্যে এভাবেই পরিষ্কারক নানা রাসায়নিক বা গুড়ো সাবান দিয়ে বস্তুর উপরিপৃষ্ঠ পরিষ্কার করার এক মহাযজ্ঞ চলছে বিশ্বব্যাপী।
তবে বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, জীবাণু দ্বারা দূষিত বস্তু ত্বক থেকে জীবাণুটি ছড়ানোর পক্ষে তেমন শক্তিশালী কোনো প্রমাণ মেলেনি। বরং, বিমানবন্দর, পানশালা বা সাবওয়ে স্টেশনের মতো ভিড়পূর্ণ স্থানে আক্রান্ত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নির্গত সূক্ষ্মকণা বাতাসে অনেকক্ষণ ধরে ভেসে বেড়ায়। আবদ্ধ স্থান আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো জীবাণু দুইয়ে মিলে তৈরি হয়- নতুন কারো সংক্রমিত হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ।
একে তারা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক বলেও উল্লেখ করেছেন।
আর শুধু বস্তু ত্বক নয়, জীবাণু থেকে বাঁচতে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে ভালোভাবে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজার ব্যবহারের জন্য মহামারির শুরু থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের ত্বক পরিষ্কার রাখা গেলেও, ঘরের ভেতরের বাতাসে জীবাণুর ভেসে বেড়ানো বন্ধ করার দিকে অধিকাংশের নজর নেই।
তাই পশ্চিমা বিশ্বের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখন ইনডোর পরিবেশে বায়ু প্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। আবদ্ধ স্থানের বাতাসের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতে এয়ার ফিল্টার যুক্ত করার তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউডের শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. কেভিন পি. ফেনলি বলেন, ''আমার মতে, বস্তু ও মানব ত্বক পরিষ্কার রাখায় অনেক অর্থ, শ্রম আর সময়ের অপচয় হচ্ছে। বায়ুবাহিত জীবাণুর হুমকি মোকাবিলা থেকে এধরনের চেষ্টা আমাদের মনোযোগ আর সম্পদ অন্যদিকেও সরিয়ে নেয়।''
৭৫ লাখ মানুষের জনবহুল শহর হংকং। এই শহরে নানা ধরনের জীবাণু প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। তাই এখানে উপরিপৃষ্ঠ পরিষ্কার রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা মানুষকে নিরাপত্তার 'মিথ্যে বার্তা' দিচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেন কিছু বিশেষজ্ঞ।
যেমন ফিরে আসা যেতে পারে হংকং বিমান বন্দরের পরিচ্ছন্নতা পদক্ষেপের বিষয়ে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ কর্মীদের পুরো শরীর (ত্বক) জীবাণুমুক্ত করার লক্ষ্যে এক ধরনের বিশেষ বুথ চালু করেছেন। কর্তৃপক্ষের দাবি, এই ব্যবস্থা সর্বাধুনিক এবং বিশ্বে প্রথম । প্রাথমিকভাবে শুধু তা কর্মীদের জন্য চালু করা হয়েছে। তবে সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আগামীতে যাত্রীদের জন্যেও এমন বুথ স্থাপন করা হবে।
কর্তৃপক্ষের এত সতর্কতা দেখে সন্দেহ নেই সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হবেন। স্থানীয় প্রশাসন কোভিড-১৯ বিরোধী লড়াই জোরশোরেই চালাচ্ছে এমন একটি চিত্র তাদের মনে তৈরি হবে। কিন্তু, কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের সূক্ষ্মকণা বিশেষজ্ঞ শেলি মিলার জানান, সংক্রমণ প্রতিরোধের দিক থেকে দেখলে এমন বুথের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
তিনি বলেন, আমাদের শ্বাসযন্ত্রের অতিসূক্ষ্ম বাষ্পীয় কণা; কথা বলা, গাওয়া নানা, চিৎকার করা, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নির্গত হয়। অন্যদিকে, জীবাণুনাশক স্প্রে'র মতো পণ্যতে এমন কিছু তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা ইনডোর পরিবেশে বাতাসের মান কমায়। ফলে মানুষ আরও বেশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে পড়েন।
'কারো শরীর জীবাণুনাশক দিয়ে সম্পূর্ণ ধুয়ে ফেললেই কেন বায়ুবাহিত জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে- তা আমার মাথায় আসে না,' তিনি যোগ করেন।
সাধারণ সর্দি-কাশি এবং ফ্লুর জীবাণু বস্তু ত্বকের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই গত শীতে চীনের মূল ভূখণ্ডে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া মাত্র ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। এবং সেই সময় তা যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসেবেই প্রশংসা পেয়েছিল।
পরবর্তীতে করা গবেষণায় নানা ধরনের বস্তুপৃষ্ঠে ভাইরাসের দীর্ঘক্ষণ থাকার প্রমাণও মেলে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ই (হু) বস্তুপৃষ্ঠ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক করে।
পরবর্তীতে পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে হু' জানায়, শ্বাসযন্ত্রের বাষ্পীয় সূক্ষ্মকণায় ভর করে জীবাণু বাতাসে ঘন্টার পর ঘণ্টা জীবিত অবস্থায় ভেসে বেড়াতে পারে। ওই বাতাসে শ্বাস নেওয়া যেকোনো ব্যক্তি তাতে আক্রান্ত হবেন। আর আবদ্ধ এবং ভিড়পূর্ণ স্থানেই এমন ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বায়ু চলাচলের আদর্শ পরিবেশ না থাকলে সেক্ষেত্রে সংক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়াবে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস