চীনকে রাগাতেই আমেরিকার ‘তাইওয়ান কার্ড’?
বিশ্বের 'গণতন্ত্র'মনা দেশগুলোকে নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে যে সম্মেলনের ডাক দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তাতে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ না পেলেও, ডাক পেয়েছে তাইওয়ান।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ওয়েবসাইটে ১১০টি দেশের তালিকা দেওয়া হয়, যে দেশগুলোকে আগামী ৯ ও ১০ ডিসেম্বর 'সামিট ফর ডেমোক্রেসি' বা 'গণতন্ত্র সম্মেলনে' আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এই আমন্ত্রণের তালিকায় নেই বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া। বাদ পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কাও। তবে, তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে অন্য দুই মার্কিন মিত্র রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়া থেকে আছে মালদ্বীপ ও নেপালের মতো দেশগুলোও।
আবার এই সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিরকালীন আরব মিত্র মিশর, সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে অংশ নেবে শুধু ইসরায়েল ও ইরাক।
সম্মেলনে রাশিয়া ও চীনকে বাদ দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাইওয়ানকে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ চীন-মার্কিন উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বহু বছর ধরেই চীন মনে করে তাইওয়ান চীনের অংশ। এটি একসময় চীনের একটি প্রদেশ হলেও পরিস্থিতির কারণে তা আলাদা হয়ে গেছে। তবে ভবিষ্যতে এটি চীনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।
তাইওয়ানের জনগণও এ বিষয়ে অনেকটা বিভক্ত। সেখানকার একটি অংশ তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চান, আরেকটি অংশ চীনের সঙ্গে একীভূত হতে চান। আর জনগণের অন্য একটি অংশ আছেন যারা চান, যেমন আছে তেমন থাকুক। অর্থাৎ চীনের অংশও নয়, আবার চীন থেকে আলাদাও নয়।
তাইওয়ানের বিষয়ে ১৯৮০'র দশকে 'এক দেশ, দুই নীতি' নামে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলো চীন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, যেখানে তাইওয়ান মূল চীনের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে, তবে তাদের স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হবে। তবে তাইওয়ান কখনোই এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। বরং মাঝে মাঝে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের 'এক দেশ, দুই নীতি' সমর্থন করলেও বরাবরই জোরদার অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রেখে এসেছে তাইওয়ানের সঙ্গে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তাইওয়ানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ওয়াশিংটন তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যকার ভার্চুয়াল বৈঠকে আমেরিকাকে সতর্ক করে দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, তাইওয়ান ইস্যুতে আমেরিকা যেন 'আগুন নিয়ে না খেলে'।
অন্যদিকে গতকাল মঙ্গলবার তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ পাড়ি দিয়েছে। এ ঘটনায় চীন বলেছে, আঞ্চলিক উত্তেজনা উস্কে দিতেই ওয়াশিংটন এমনটি করে থাকে।
আবার গত এক বছর ধরেই নানা সময়ে তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চল দিয়ে বারবার চীনা যুদ্ধবিমান উড়ছে। ফলে বৈশ্বিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা।
সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমেরিকা তো এক চীন নীতি মেনেই নিয়েছে এবং সবাই জানে তাইওয়ান চীনের অংশ। আমেরিকার এ ধরনের রাজনীতি করে আর কতোদিন? চীন একটা অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে। তাকে কোনঠাসা করতে হবে, যা আমেরিকার নীতিতে আগেও ছিলো। আমার মনে হয় না এগুলো নিয়ে বিশ্ব এখন চিন্তিত। যেভাবে প্যান্ডেমিক এসেছে, আমেরিকা তার নিজেদের দেশের সমস্যার সমাধান যতো তাড়াতাড়ি করতে পারবে ততোই ভালো।"
তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও তাইওয়ানের আকাশে চীনা যুদ্ধবিমানের চলাচলের কারণে কোনো ধরণের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হবে কিনা- এমন প্রশ্নে এই আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, "চীনারা খুব চালাক। তারা ভালো করেই জানে কখন কী করতে হবে। এখানে বড় কিছু হবে না, এটা বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ। চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমেরিকার জন্য নিজের মাথাতেই হাতুড়ি মারা।"
সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স' এর ২০২১ সালের 'বৈশ্বিক গণতন্ত্র পরিস্থিতি' প্রতিবেদনে 'ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক দেশের' সারিতে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নামও।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের 'গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর' খ্যাত সেই যুক্তরাষ্ট্রেই নেই সার্বজনীন ভোটাধিকার। দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মতো মৌলক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘু।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, "আমেরিকার নিজের দেশেই গণতন্ত্র নেই। নিজের দেশেই মানুষ ক্যাপিটল হিলে ঢুকে হামলা চালায়, চেয়ারে বসে থাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই গণতন্ত্র রাখতে পারেননি নিজের দেশে। এটা তো হাস্যকর এখন তারা যাচ্ছে তাইওয়ানের গণতন্ত্র উদ্ধার করতে। বরং নিজের দেশে কীভাবে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা যায় এবং আমেরিকার জনগণ যাতে জেগে উঠে সেটা দেখা দরকার।"
গণতন্ত্র সম্মেলনের জন্য আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের এ দাওয়াত তালিকায় বাংলাদেশের না থাকাকে 'শাপেবর' হিসেবেই দেখছেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশকে যদি দাওয়াত না দিয়ে থাকে তবে সেটা বাংলাদেশের জন্যই 'ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ' (আপাতদৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও, ফলাফল ভালো)। আমেরিকার এই গণতন্ত্র নিয়ে পৃথিবী খুব একটা নড়েচড়ে উঠবে না। কারণ ওদের নিজ দেশেই গণতন্ত্র নেই।"
আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই বিশ্লেষক বলেন, "দাওয়াত দিলে বরং বাংলাদেশ যাবে কি যাবে না সেটা নিয়ে একটা চিন্তা ছিল। আমেরিকার উচিৎ হবে তাদের নিজ দেশের গণতন্ত্র দেখা, কারণ সেটা একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই গণতন্ত্র নিয়ে পৃথিবী জয় করার মতো অবস্থা আমেরিকার এখন আর নেই।"