জননেত্রী থেকে খলনায়িকা: গণহত্যায় যে জেনারেলদের সমর্থন দিয়েছেন তারাই আজ সু চিকে দোষী সাব্যস্ত করছে
গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় দীর্ঘকাল গৃহবন্দী থেকেছেন। তারপর এক নির্বাচনে বিজয়ের পর বন্দীকারী জেনারেলদের সাথে আপোষ করেই সরকার গঠন করেন। ক্ষমতায় এসে কট্টর জাতীয়তাবাদে অন্ধ হয়ে ছাড় দিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনে। উল্টো দেন প্রত্যক্ষ সমর্থন।
গত ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানে সেই অং সান সু চি'র নেতৃত্বের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী। আরও একবার তিনি বন্দী হন জান্তা শাসকদের হাতে। এরপর তারাই সু চি'র বিচার শুরু করে।
তবে মুদ্রার অপরপিঠও সত্য। সু চি'র সরকার প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কিছু সংস্কার এনেছিল। অভ্যুত্থান তার কয়েক দশকব্যাপী চেষ্টায় আনা অর্জনগুলো এক লহমায় কেড়ে নিয়েছে।
আজ সোমবার (৬ ডিসেম্বর) সেনাবাহিনীর আনা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সু চি'কে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন একটি আদালত।
৭৬ বছরের সু চির বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১ মামলার মধ্যে এদিন দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
প্রথম মামলায় তাকে দুর্যোগ আইনের আওতায় নির্ধারিত করোনা বিধি ভঙ্গ করায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ জন্য তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর রায়ে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভিন্নমতাবলম্বীদের উসকে দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দেওয়া হয়েছে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড।
তবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ঘোষণায় সাজা দুই বছর কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির জান্তা সরকারের প্রধান। আদালতের রায় ঘোষণার পরই তিনি একথা জানান।
অথচ কিছুদিন আগেও দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। সামরিক ক্যুর মাত্র ১৪ মাস আগেই হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যায় অভিযুক্ত জেনারেলদের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন সু চি। ২০১৭ সালে সংগঠিত ওই গণহত্যায় তার সমর্থন বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে। সু চি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। এমনকি তিনি গণহত্যার ঘটনাকেও অস্বীকার করেছেন সেসময়।
সু চির রাজনীতি নিয়ে তাই বিতর্ক-সমালোচনার অন্ত নেই। তবুও নিজ দেশে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। গণতন্ত্রের জন্য তার সংগ্রামই বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে তাকে দেশনায়কের মর্যাদা এনে দেয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা ফেলেনি।
সংখ্যাগরিষ্ঠের এই রাজনীতিই ছিল সু চির জনসমর্থনের উৎস। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে সিংহভাগ জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছিলেন। যা ছিল অর্ধ-শতক পর দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশটিতে প্রথম বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার ঘটনা।
এই অর্জনের জন্য ১৫ বছর গৃহবন্দী থেকেছেন সু চি। তবে সমঝোতা করে গঠিত তার প্রশাসনে প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগের নিয়ন্ত্রণ জেনারেলদের দেওয়া হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠের এই মিশ্র সরকার প্রথম থেকেই ছিল বর্মী ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নির্ভর; যা মিয়ানমারের অধিকাংশ সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। কয়েক দশক ধরে তাদের সাথে সেনাবাহিনীর চলে আসা গৃহযুদ্ধগুলোরও অবসান করতে পারেননি সু চি। তার আমলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ এবং নাগরিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে পুরোনো মিত্রদের সাথে সু চি ও তার দলের দূরত্ব বাড়ছিল।
সামরিক বাহিনীর সাথেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক পরিবেশ যেন তৈরি হচ্ছিল। মন্দের ভালো হিসেবেই এই নতুন আধা-গণতন্ত্রকে স্বাগত জানায় জনগণ। কিন্তু, নতুন প্রজন্মের ভেতর আরও গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়াও জন্ম নিচ্ছিল।
এই অবস্থায় গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চি'র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলিকে বিশাল ব্যবধানে হারালে সেনাবাহিনী ঘাবড়ে যায়। ভোটে বিপুল কারচুপির অভিযোগ আনেন ক্ষমতাধর জেনারেলরা।
তারপরই আসে ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থান। এসময় প্রথমেই সু চির বিরুদ্ধে করোনা বিধি লঙ্ঘণ এবং নিবন্ধনহীন ওয়াকিটকি রাখার অভিযোগে মামলা করা হয়।
তারপর আরও গুরুতর অভিযোগে একের পর এক মামলা হতে থাকে। যার মধ্যে ছিল- সহিংসতায় উস্কানি, দুর্নীতি এবং সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের মতো অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে করা প্রায় এক ডজন মামলায় সু চিকে মোট ১০০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ রয়েছে জান্তা সরকারের কাছে।
সোমবার সু চির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর মিয়ানমারের রাজপথে হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ। তরুণ প্রজন্ম 'মা সু চির মুক্তি চাই' স্লোগান দিয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর জান্তা প্রশাসনের চালানো ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন উপেক্ষা করেই তারা রাজপথে নামে।
সু চির সংগ্রামী অতীত:
মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক অং সানের মেয়ে সু চি। ১৯৪৭ সালে যখন অং সানকে হত্যা করা হয়, তখন সু চির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। এরপর শৈশব ও যৌবনের বেশিরভাগ সময়টাই বিদেশে কাটিয়েছেন।
তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানেই ব্রিটিশ একাডেমিক মাইকেল এরিসের সঙ্গে তার পরিচয় ও পরিণয়। তাদের দুই ছেলে সন্তান রয়েছে।
দেশে ফেরার ডাক আসলে বাঁধা দিতে পারবেন না, বিয়ের আগেই এরিসকে এই অঙ্গীকার করান সু চি। ১৯৮৮ সালে আসে সেই মুহূর্ত। সু চি জানতে পারলেন তার মা মৃত্যুশয্যায়। তখনই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
মিয়ানমারের তখনকার রাজধানী রেঙ্গুনের নাম বদলেই আজ হয়েছে ইয়াঙ্গন। রেঙ্গুন তখন উত্তাল ছাত্রদের নেতৃত্বে জান্তা বিরোধী আন্দোলনে। এই আন্দোলন দমনে জান্তা সরকারের চরম নিষ্ঠুরতা দেশটিকে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল।
কিন্তু সু চি ভীত হননি। সুবক্তা বলে পরিচিত সু চি অচিরেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, 'মুক্ত স্বাধীন বার্মাই' ছিল তার পিতার স্বপ্ন।
ওই আন্দোলন সর্বশক্তি দিয়ে দমন করে জান্তা সরকার। সব নেতাকর্মীকে হয় হত্যা নাহয় জেলে পোরা হয়। সু চি হন গৃহবন্দী। এমনকি জনসম্মুখে সু চি'র নাম উচ্চারণ করার অপরাধে জেলে গিয়েছেন তার অনেক সমর্থক।
ক্ষীণকায় ও মৃদুভাষী সু চি মিয়ানমারের সেনা জান্তার নিষ্ঠুরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ ধরে রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালে গৃহবন্দী থাকা অবস্থাতেই তাকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৭ সালে সু চির স্বামী এরিস মারা যান। কিন্তু, তার শেষকৃত্যে যোগ দিতে গেলে দেশে আর ফিরতে পারবেন না, এই শঙ্কায় সু চি গেলেন না।
১৯৯৮ সালে কিছু সময়ের জন্য গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি পান সু চি। এসময় ইয়াঙ্গনের বাইরে তার সমর্থকদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে, সেনাবাহিনী তাকে বাধা দেয়। আপোষহীন সু চি এসময় তাকে বহনকারী গাড়িতে টানা কয়েক দিন ও রাত অবস্থান করেন। প্রচণ্ড গরম ও পানি শূন্যতার পরও তিনি সেখান থেকে নড়েননি। ছাতায় বৃষ্টির পানি জমিয়ে তা পান করেছেন।
২০০৩ সালে তার প্রাণনাশের চেষ্টা করে সামরিক বাহিনীর সমর্থকরা। তার গাড়িবহরে বর্শা ও রড নিয়ে হামলা চালিয়ে সু চির কয়েকজন সমর্থককে হত্যা করে। আহত হন অনেকেই। সে যাত্রাও অল্পের জন্য বেঁচে ফেরেন সু চি।
তারপর আবারো তাকে গৃহবন্দী করে সেনাবাহিনী। বন্দী থাকার সময়েই তিনি বাড়ির ফটকের পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন। এসময় তার চারপাশে কড়া প্রহরায় থাকতো পুলিশ।
নিবেদিত প্রাণ বৌদ্ধ বলে পরিচিত সু চি অনেক সময় আধ্যাত্মিক উপমায় তার গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করেছেন।
তবে বহির্বিশ্বের চাপের মুখে ২০১০ সালে বেশকিছু গণতান্ত্রিক সংস্কার করে সেনাবাহিনী। হাজার হাজার অশ্রুসজল সমর্থকদের সামনে মুক্তি পেয়ে আসেন সু চি।
পশ্চিমা বিশ্ব তাকে অত্যন্ত সম্মান দেখায়। ২০১২ সালে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিয়ানমার সফরে যান বারাক ওবামা। এসময় তিনি সু চিকে 'পুরো বিশ্বের সকলের জন্য অনুকরণীয়' বলে সম্বোধন করেন।
ওবামার সফরের পর মিয়ানমারের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা হয়। তবে গণতান্ত্রিক সংস্কার কতদূর করা সম্ভব- তা নিয়ে সু চি শুরু থেকেই সংশয়ী ছিলেন।
পশ্চিমা আশাবাদের হাত ধরেই আসে ২০১৫ সালের নির্বাচন। সেই জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে মাত্র দুই বছর পর রোহিঙ্গা গণহত্যার কালে। সে সময় প্রায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা ২০১৮ সালের আগস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরাকানে গণহত্যা ও ধর্ষন চালিয়েছে বলে জানান।
এনিয়ে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে এই সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ আদালতে সামরিক বাহিনীর পক্ষে ওকালতি করেন সু চি। তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যাকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান বলে দাবি করে, গাম্বিয়ার আনা গণহত্যার অভিযোগ নাকচ করে দিতে আদালতের প্রতি আহবান জানান।
বিশ্ব মানবতা অন্যায়ের পক্ষে সু চির সেই অবস্থানে ধিক্কার জানিয়েছিল। আজ সু চি' সেই অন্যায়কারী জেনারেলদের সাজানো বিচারেই দণ্ডিত হলেন।
- সূত্র: রয়টার্স