জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান গতি মানবজাতির অস্তিত্বকে বিলীন করবে: জাতিসংঘের যুগান্তকারী রিপোর্ট
দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প স্থাপন, শক্তি চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার, বন উজাড়, ভূমির অপরিণামদর্শী ব্যবহার এবং মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ওপর সীমাহীন অত্যাচার করেছে মানবজাতি। কিন্তু, নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতোই এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং সেকারণে জলবায়ু পরিবর্তনের চক্র। সুদূর ভবিষ্যৎ নয়, মানবজাতির অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধিকে বর্তমান যুগেই হুমকির মুখে ফেলেছে এসব নাটকীয় পরিবর্তন।
তাপপ্রবাহের কারণে বিগত এক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে দাবানলের প্রচণ্ডতা। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে চলায় ঘন ঘন সামুদ্রিক ঝড় আছড়ে পড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলে। শুষ্ক অঞ্চলগুলো মরুপ্রবণ হয়ে উঠছে, আর খরা হানা দিচ্ছে ইতঃপূর্বে সবুজের সমারোহ ছিল এমন অঞ্চলেও।
আকস্মিক বন্যায় হচ্ছে বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি। সব মিলিয়ে এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে, মানুষের জীবন ও জীবিকায়।
এমন বাস্তবতার কথাই উঠে এসেছে আজ সোমবার (৯ আগস্ট) প্রকাশিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে।
আইপিসিসি'র এবারের জলবায়ু পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি অনেক স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। প্রতিবেদনটির উপসংহারে বলা হয়, মানুষের দ্বারা যে জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। একারণে পৃথিবীর আবহাওয়া চক্র ও পরিবেশে সর্বব্যাপী এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন এসেছে।
এবারের প্রতিবেদনটি সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, আবহাওয়া বিজ্ঞান ও জলবায়ুর তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়।
শুধুমাত্র গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং একইসাথে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের মাধ্যমেই মানবজাতি জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বনাশা চক্রকে ঠেকাতে পারবে বলেও উল্লেখ করেছেন আইপিসিসি'র বিশেষজ্ঞরা।
এনিয়ে আইপিসিসি প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক মাইকেল ই. মান বার্তাসংস্থা সিএনএন'কে বলেন, "মোদ্দা কথা, আমাদের হাতে আর বাড়তি সময় নেই। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর দুয়ারে কড়া নাড়ছে না বরং তা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর ঘটনাবলী মানব সভ্যতাকে 'রেড সিগন্যাল' দেখাচ্ছে। যার কারণ অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রার নাটকীয় গড় বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীরা এর আগে কখনো এমন অবিশ্বাস্য গতিতে তাপমাত্রা বাড়তে দেখেননি।
আইপিসিসি'র ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির পরিণতি নিয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল। এর পরিণতি কতোটা ব্যাপক হবে সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। কারণ গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা একটি সার্বিক চিত্র; এটি অঞ্চলভেদে তাপমাত্রার ব্যাপক হেরফের তুলে ধরে না। যেমন পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চলে এরমধ্যেই তাপমাত্রা ৩/৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে।
তবে ২০১৮ সালের ওই প্রতিবেদনের পরও অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয়েছে, যার ফলে তাপমাত্রা আরও বেড়েই চলেছে।
এসব কারণে ২০৫০ সালের আগেই শিল্প-বিপ্লব পূর্ব সময়ের তুলনায় ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়তে পারে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা। যা কৃষিকাজ ও মানব স্বাস্থ্যের সহনশীলতার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ প্যানেলটির সবচেয়ে ইতিবাচক পূর্বাভাস অনুসারে, আজ থেকেই যদি বৈশ্বিক গ্রিহাউজ গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায় এবং ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামে- তারপরও গড় তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াস হবেই। অবশ্য এরপর তা কমতে শুরু করবে।
কিন্তু, তেমন অগ্রগতির কোনো চিহ্ন না দেখায় সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব নিরূপণে এবার বাস্তবিক বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর জোর দেন বিজ্ঞানীরা, এর মাধ্যমে মানুষ কীভাবে পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানকে তছনছ করে দিচ্ছে- সেটাও তুলে ধরা হয়। গত শুক্রবার আইপিসিসি'র এ প্রতিবেদনকে অনুমোদন দেয় জাতিসংঘের ১৯৫টি সদস্য দেশ। বর্তমান পর্যালোচনার ভিত্তিতে চারটি রিপোর্ট পর্যায়ক্রমে আগামী বছর নাগাদ প্রকাশিত হবে।
আর মাত্র তিন মাস পর, নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কোপ-২৬। বর্তমান প্রতিবেদন বৈজ্ঞানিক তথ্যের একটি উচ্চ মানের প্রামাণিক দলিল হয়ে থাকলো; যা ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়া দেশগুলোর ওপর দূষণ কমানোর চাপ সৃষ্টি করবে। নীতি-নির্ধারকদের সঠিক কৌশল ও বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবনের সুযোগও করে দেবে এটি।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, "আজকে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি মানব জাতির জন্য মহাবিপদের সংকেত। সমস্ত প্রমাণ বলছে এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাস এবং বনভূমি উজাড়করণ আমাদের ধরণীকে গলাটিপে হত্যা করছে। শত শত কোটি মানুষকে নিয়ে গেছে আসন্ন ঝুঁকির দ্বারপ্রান্তে।"
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কিছু দেশ নিজেদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর দৃঢ় অঙ্গীকার করলেও; তারা নিজেদের ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এনিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও ২০৩০ সাল নাগাদ তার প্রকৃত বাস্তবায়নের মধ্যেও পার্থক্য বিশাল।
আইপিসিসি'র সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কো ব্যারেট বলেছেন, "বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতি ডিগ্রী, প্রতি ডিগ্রীর একেকটি অংশ এবং এমনকি অর্ধেক ডিগ্রী কমানোর গুরুত্বও অপরিসীম। যা বিরূপ জলবায়ু প্রভাব কমাতে তাৎপর্যমূলক প্রভাব ফেলবে।"
তিনি আরও বলেছেন, "তাই প্রতিটি দেশ যে পরিমাণ নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নিচ্ছে-তার যেমন সুফল আছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থ হলে পুরো বিশ্বকে অপরিসীম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।"
এব্যাপারে এডিনবরো ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডেভ রে মন্তব্য করেন, "সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে আসা দিকগুলোকে বিশ্বনেতাদের মনে গেঁথে নিতে হবে। তাতে করে নভেম্বরের সম্মেলনে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।"
- সূত্র: সিএনএন/ সিএনবিসি