ট্রাম্পের নির্দেশে বাক্স-পেটরা গুটিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান-ইরাক ছাড়তে হবে
আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের জের ধরে অর্ধেক সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন এ ঘোষণা দেয়।
আফগানিস্তানে অবস্থানরত সাড়ে চার হাজার সেনার সংখ্যা কমিয়ে আড়াই হাজারে নিয়ে আসা হবে। সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই। একারণে তালেবান বিদ্রোহীরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আফগান কর্মকর্তারা।
এতে করে, আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশ এবং আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আফগান সরকারি কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও। পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থিত আফগান সেনাবাহিনীর কান্দাহার প্রদেশের আঞ্চলিক কমান্ডার কর্নেল জাবিউল্লাহ ঘোরজাং এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'মার্কিন সামরিক সহায়তা না পেলে তালেবান এতদিনে কান্দাহার শহরে পৌঁছে যেত।'
কাতারের মধ্যস্ততায় আফগান সরকার এবং তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তির আলোচনা শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা আসে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে প্রতিনিধি পরিষদে নিজ দলের সদস্যদেরই সমালোচনার মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট- ন্যাটোও এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এদিকে ইরাকে অবস্থানরত সাড়ে তিন সেনার সংখ্যা কমিয়ে আড়াই হাজারে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে পেন্টাগন। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল কাদিমি জানিয়েছেন এ সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক।
ইরাকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার কিছু সময় পরই দেশটিতে মার্কিন দূতাবাসের পাশে এবং বাগদাদের আরও কয়েকটি স্থানে মর্টাল শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১ জন শিশু নিহত এবং ৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সোমালিয়ায় অবস্থানরত মার্কিন সেনা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হলেও নির্দিষ্ট সংখ্যা জানানো হয়নি। আল কায়েদার সাথে যুক্ত জঙ্গীগোষ্ঠী আল শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সহায়তার কাজে প্রায় ৭০০ মার্কিন সেনা আছে দেশটিতে।
সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটির বিশেষায়িত নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিশ্লেষকরা। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ডিজাস্টার গ্রুপের বিশ্লেষক ওমর মাহমুদ জানান, 'সোমালিয়ার সামগ্রিক অবস্থা এখনো ঝুঁকির মুখে এবং আল শাবাবকে প্রতিহত করার কাজও অসম্পূর্ণ।'
আফগান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ আমারখেল জানান, 'জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একা লড়াই করার মতো সামর্থ্য আফগান সেনাবাহিনীর নেই; অন্য দেশের সমর্থন প্রয়োজন। তালেবান পূর্বের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সমর্থনে না থাকলে শীঘ্রই তালেবান ক্ষমতা দখল করবে। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় এটাই।'
মঙ্গলবার আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আসাদুল্লাহ খালিদ সংসদে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণে ভীত না হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'আমরা এব্যাপারে চিন্তিত নই; আমরা স্বাধীনভাবে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম।'
তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এ বক্তব্যে চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না অনেক সামরিক কর্মকর্তাই। ফিমেইল ভিউজ মার্কেটিং এর সদস্য মেত্রা মেহরান জানান, 'এখনো তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির আলোচনায় আফগান সরকার কোনো চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। চুক্তি নিশ্চিত হওয়ার আগেই এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া যুক্তিযুক্ত নয়।'
মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব ক্রিস্টোফার মিলার এপ্রসঙ্গে জানান, কিছুসংখ্যক সেনা প্রত্যাহারের কারণে বাকি সেনাদের, কূটনীতিক এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই। সিদ্ধান্তের কারণে আফগানিস্তানে মার্কিন নীতিও পরিবর্তিত হবে না।
মিলার এব্যাপারে ন্যাটোর কর্মকর্তাদের জানিয়ে তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলেও জানান। 'আমরা একসাথে এ লড়াই শুরু করেছি, একসাথে কাজ করেছি, সঠিক সময়ে আসলে একসাথেই আফগানিস্তান ত্যাগ করবো।'
তবে এর পরিণতির ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে সতর্ক করেন ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টোলেনবার্গ। তিনি বলেন, 'সঠিক সময়ের আগেই সেনা প্রত্যাহার করে নিলে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।' মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে পরও ন্যাটো আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা করার কাজ চালিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
আফগানিস্তানের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে ইতালি ও জার্মানির সেনা সদস্যরাও পরিবহন ও নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কারণে জার্মানি ও ইতালির পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে।
কাতারের মধ্যস্থতায় তালেবানের সঙ্গে চুক্তির আলোচনার সাথে জড়িত আফগান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তই নিক চুক্তির আলোচনাই প্রথম অগ্রাধিকার হবে।
আলোচনার সাথে যুক্ত আফগান সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক মাজরুহ জানান, 'আমরা তালিবানের সাথে আলোচনা করছি, তবে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ভাবছি না। চুক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠাই এখন গুরূত্বপূর্ণ।'
যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে স্বাক্ষরিত গত ২৯ ফেব্রুয়ারির চুক্তিতে আল কায়েদার সাথে সংযোগ ছিন্ন করতে সম্মত হয় তালেবান। চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়ে গেলেও তালেবান আল-কায়েদার সাথে সংযোগ ছিন্ন করেছে এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কান্দাহার প্রদেশের বাসিন্দা হায়াতুল্লাহ (৩৩) জানান, শান্তিচুক্তি এবং কুটনৈতিক আলোচনার কোনো সুফলই দেখা যাচ্ছেনা বাস্তবে; দিন দিন নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হচ্ছে। তিনি বলেন, 'শহরের অবস্থা শোচনীয়, সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে। আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর অবস্থা আরও খারাপ হবে এই ভয়ে আছি।'
- সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস