ডেল্টা প্রতিরোধে সিনোভ্যাকের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় থাই চিকিৎসকদের, চাইছেন ফাইজার ভ্যাকসিন
বিশের কোঠায় থাকা ডাক্তার ওয়াইপাকে গত পাঁচ বছর ধরে সপ্তাহে ৩-৫ দিন ৩৬ ঘন্টা ডিউটি, ৮ ঘন্টা ছুটির মতো কঠোর শিফটের নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে।
তাকে এত সময় ধরে কাজ করতে হয় কারণ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের প্রান্তে অবস্থিত পাথুমথানি প্রদেশের ব্যস্ততম পাবলিক হাসপাতালের আবাসিক ওয়ার্ড, অনাবাসিক সেবা ও ইমার্জেন্সি রুম অপারেশনের তদারকি করতে হয় তাকে।
কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে এসে এই দীর্ঘ কর্মঘন্টা তার কাছে আরও বেশি দীর্ঘতর ও বোঝার মত মনে হয়। হাসপাতালের মাত্র ২০ জন ডাক্তার মিলে দৈনিক ৭০০ রোগীর সেবা করেন। এরই মধ্যে এপ্রিলে করোনাভাইরাসের তৃতীয় তরঙ্গের আগমনের ফলে হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে।
ভাইরাসের সর্বশেষ তরঙ্গের আঘাতে সংক্রমিত হয়েছেন তিন লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি থাই নাগরিক। সব মিলিয়ে থাইল্যান্ডে বর্তমানে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ৫৩ হাজার ৭১২ জন। শুধুমাত্র মঙ্গলবারই দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৮,৬৮৫ জন। ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের প্রভাবে সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টকে মনে করে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত সবচাইতে প্রাণঘাতী ভ্যারিয়ান্ট যা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে প্রতিরোধ করে দিতে অধিক সক্ষম।
ওয়াইপা জানালেন, 'আমাদের প্রধান লক্ষ্য এখন কোভিড-১৯ রোগীরা যাদের পেছনে ডাক্তারদের বেশি সময় যায়। খুব শিগগিরই আমাদের অক্সিজেন, ওষুধপত্র ও নেগেটিভ প্রেশার রুম ফুরিয়ে যাবে।'
অন্যসব ফ্রন্টলাইন কর্মীদের মত ওয়াইপাও সীমাবদ্ধ রসদের মাধ্যমেই কোভিডের সাথে লড়াই করতে শিখে গেছেন এবং এত লম্বা সময় কাজ করা নিয়ে কোনো ক্ষোভ জানাননি।
কিন্তু, তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই নিয়ে যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন এই মাসের শেষে থাইল্যান্ডকে ১৫ লাখ ডোজ ফাইজার ভ্যাকসিন দেবে এবং পরে আরও ২ কোটি ডোজ সরকার অর্ডার দিবে; তখন তিনি এবং তার সহকর্মীরা ফাইজার ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন না।
এই মাসের শুরুতেই ফাঁস হওয়া এক মেমো থেকে জানা যায়, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ফ্রন্টলাইন চিকিৎসকদের দিতে নিষেধ করেছেন; কারণ তাদের ধারণা, এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে চীনের উৎপাদিত সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের প্রতি বিশ্বাস কমে যাবে। এপর্যন্ত থাইল্যান্ডের অধিকাংশ নাগরিককে টিকা দিতে সিনোভ্যাকই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; যার ফলে জনগণের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
মেমোতে লেখা হয়, 'আমরা যদি ফ্রন্টলাইন চিকিৎসা কর্মীদের ফাইজার টিকা দেই, তাহলে সাধারণ মানুষ ভাববে যে সিনোভ্যাক আসলে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। এরকম হলে, তাদেরকে জবাব দেয়ার মত যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।'
ওয়াইপা জানান, মেমোর খবরটি তাকে অত্যন্ত হতাশ ও দুঃখিত করেছে। তিনি বলেন, 'আমি জানি সেখানে অনেক সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন, তারা আমার মত ডাক্তারদেরকে এর জবাব দিতে বাধ্য।'
এর আগে থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে 'মোর মাই তন' নামে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়, সেখানে পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিলেন ওয়াইপাও। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা চান, ফাইজারের মত এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন ভ্যাকসিনই যেন থাইল্যান্ডের সবাইকে দেয়া হয়।
অন্যান্য সহকর্মীর মত ওয়াইপাও সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নিয়েছেন। থাইল্যান্ডে বয়স্ক ব্যক্তি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকাদান শুরু হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে।
কিন্তু সিনোভ্যাক নেয়ার পরেও কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন কিছু স্বাস্থ্যকর্মী-এমনটা জানার পর ওয়াইপা চাইছেন ফাইজারের একটি বুস্টার শট নিতে।
গত রোববার বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায়, সিনোভ্যাকের দুই ডোজ নেওয়া ৬ লাখ৭৭ হাজার ৩৪৮ জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর মধ্যে ৬১৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন নার্স মারাও গেছেন এবং আরেক মেডিকেল কর্মীর অবস্থা সংকটাপন্ন।
পরদিন রয়টার্স জানায় যে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সিনোভ্যাকের প্রথম ডোজ নিতে এবং দেশে তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে নিতে, যদিও তারা এদিন কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি।
কিন্তু সিনোভ্যাক ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা মিলিয়ে ডোজ নেয়ার কার্যকারিতা কতখানি, সে সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়নি। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, এটি আসলে সিনোভ্যাক টিকার প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ারই লক্ষণ। ২০১৯ সালে আমেরিকান ম্যাগাজিন 'সিইওওয়ার্ল্ড' মনোনীত সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশগুলোর তালিকায় থাকার পরেও, ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট কিভাবে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তা নিয়েও মানুষ চিন্তিত।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, থাই নাগরিকরা শুধু কোভিড পরীক্ষা করতে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিকিৎসা পাওয়ার আগেই কতজন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, সেই হিসাবও দেখানো হয়।
শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ফাইজার টিকা দিতে না চাওয়ার ফলেই নয়, সিনোভ্যাক টিকা সম্পর্কে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত ডেটার অভাবে সাধারণ মানুষ এর প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে বলে জানা যায়।
সন্দেহের আরও একটি কারণ হলো, থাইল্যান্ডের মত ইন্দোনেশিয়াও তাদের জনগণকে সিনোভ্যাক টিকা দিয়েছে এবং তারাও এখনো সর্বোচ্চ সংক্রমণের সাথে লড়াই করছে। টিকার ঘাটতি থাকায় থাই সরকারের মিশ্র টিকা দেওয়াকে কিছু চিকিৎসক সমর্থন দিলেও, এর বিরোধিতাও করেছেন অনেকে। সিনোভ্যাক টিকার উপর ভরসা করা নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেছেন দেশটির একাধিক চিকিৎসক।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট