তথ্যপ্রযুক্তিতে সম্পদ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন যুগে ভারত
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হতে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় আগে যাত্রা শুরু করেছিল ভারতের আইটি সেক্টর। তারপর থেকে সম্পদ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক নয়া যুগের সূচনা করে চলেছে এ খাতটি।
এখন প্রযুক্তির নতুন সম্ভাবনার জগতে প্রবেশ করতে প্রস্তুত এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতিটি। এরমধ্যেই সেখানে জন্ম নিয়েছে জুম ও স্ল্যাক- এর মতো নতুন প্রজন্মের সফটওয়্যার কোম্পানি।
হংকং ভিত্তিক অ্যাংলো-ডাচ প্রফেশনাল সার্ভিস নেটওয়ার্ক কেপিএমজি'র এক সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধনে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বাধ্য করেছে, যা সফটওয়্যার সেবা প্রদানকারী কোম্পানির প্রভাব আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের সেবামূলক সফটওয়্যার প্রদানকারী কোম্পানিকে বলা হয়, সফটওয়্যার অ্যাজ অ্যা সার্ভিস বা সংক্ষেপে 'সাস কোম্পানি। কর্মীদের ঘরে থেকে দাপ্তরিক কাজ করার সুবাদে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা গত বছর সপ্তাহে ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
সাস কোম্পানিগুলো মূলত এমন ওয়েব বেইজড অ্যাপ্লিকেশনের সুবিধা দেয় যা সফটওয়্যারের নিরাপত্তাসহ সেটি কত ভালোভাবে পারফর্ম করবে- সেদিকটাও নিশ্চিত করে।
বিশ্বের অন্যতম সুপরিচিত সাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম; জুম (জেডএম) এবং কর্মক্ষেত্রে ম্যাসেজিং সেবাদানকারী অ্যাপ- স্ল্যাক নির্মাতা মার্কিন জায়ান্ট এসএপি কনকার অ্যান্ড সেলসফোর্স।
ভারতীয় সাস শিল্পে যুক্ত কোম্পানিগুলোর মূল্য ২০৩০ সাল নাগাদ এক লাখ কোটি ডলার হবে বলে আভাস দিয়েছে শিল্প সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সংগঠন সাসবুমি ও বাণিজ্যিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিন্সে অ্যান্ড কোং। এ সময়ে অন্তত পাঁচ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে তারা।
সংস্থা দুটির যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ভারতে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা প্রায় এক হাজার, এরমধ্যে দশটি কোম্পানি ন্যূনতম শত কোটি ডলারের বাজার মূল্যায়ন অর্জন করে 'ইউনিকর্ন' হয়ে উঠেছে।
ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সাস কোম্পানি ফ্রেশওয়ার্কস- এর প্রধান নির্বাহী গিরীশ মাথরুবোথাম বলেন, "৯০-এর দশকের তুলনায় বর্তমান অবস্থান আইটি সেবা দাতা শিল্পের সামনে অনেক বড় সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে।"
গত মাসে পুঁজিবাজারে নিবন্ধনের লক্ষ্যে আইপিও ছাড়ার আবেদন করে তার কোম্পানিটি। চলতি বছর ফ্রেশওয়ার্কস-সহ ভারতের অন্যতম বড় কয়েকটি প্রযুক্তি খাতের ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠান বাজারভুক্ত হতে চলেছে।
প্রায় এক দশক আগে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর চেন্নাইয়ে সীমিত পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল ফ্রেশওয়ার্কস । মার্কিন জায়ান্ট সেলসফোর্সের মতোই তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় সহায়ক সফটওয়্যার সেবাও প্রদান করছে। ভারতীয় প্রযুক্তিখাতের যেসব কোম্পানি সবার আগে শত কোটি ডলারের মূল্যায়ন অর্জন করে তাদের মধ্যে ফ্রেশওয়ার্কস অন্যতম।
ডেটা ফার্ম ট্র্যাক্সেনের তথ্যমতে, ইতোমধ্যেই কোম্পানিটি টাইগার গ্লোবাল ও অ্যাক্সেল- এর মতো বিখ্যাত বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে। তাদের গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ৫০ হাজারের বেশি।
বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসায়ে সেবাদানেও অগ্রগামী হয়ে উঠেছে ভারতীয় সাস খাতের কোম্পানিগুলো। স্পা ও বিউটি সেলুনগুলোর জন্য বিশেষায়িত সফটওয়্যার তৈরি করে যেমন জেনোটি নামের একটি ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠান।
সাস খাতের ১০টি ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০২০ সালে এ মাইলফলক অর্জন করে ছয়টি প্রতিষ্ঠান। দ্রুতগতির এ বিকাশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করেছে।
সাসবুমি'র নিজস্ব প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে ভারতীয় সাস খাতের কোম্পানিগুলো, যা ছিল ২০১৮ ও ২০১৯ সালের চাইতে চারগুণ বেশি।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিনিয়োগকারীদের ভিড়
গত এক দশকে ভারতে স্থানীয় সফটওয়্যার পরিষেবার বাজার অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদেশে সেবা রপ্তানি। এনিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে 'সাড়া পড়ে গেছে' বলে মন্তব্য করেন পুঁজিবাজারে সম্পদ ব্যবস্থাপক সংস্থা- সিকোইয়া ক্যাপিটাল ইণ্ডিয়া'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহিত ভাটনাগর।
সাস পরিষেবার বৈশ্বিক বাজারে ভারত এখনও ছোটখাট খেলোয়াড় হলেও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এক সময় দেশটি এখাতে বিশ্ব নেতৃত্ব দিতে পারে। এক্ষেত্রে সহায়ক হবে দেশটির ইংরেজিভাষী বিপুল সংখ্যক ডেভেলপার এবং তুলনামূলক কম টাকায় তাদের নিয়োগদানের সুবিধা।
ভারতের আইটি শিল্পের উত্থানের কল্যাণে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং দেশটির অন্যতম সেরা ক্যারিয়ার নির্বাচনের উপায় হয়ে উঠেছে।
ভাটনাগর সিএনএন বিজনেস'কে বলেন, "পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডেভেলপার কমিউনিটি ভারতেই রয়েছে। তাদের অনেকেই আগে বিশ্ব সেরা সব প্রযুক্তি কোম্পানিতে কাজ করছেন।"
পোস্টম্যান ইঙ্ক নামক স্থানীয় একটি প্রযুক্তি উদ্যোগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অভিনব আস্থানা এমন অভিজ্ঞ ডেভেলপারদের একজন। ইতঃপূর্বে, তিনি বেঙ্গালুরুতে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি ইয়াহু'র স্থানীয় অফিসে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তার নিজ প্রতিষ্ঠান ও পরিষেবা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অভিনব আস্থানা অ্যাপ্লিকেশন পারফর্মিং ইন্টারফেস বা এপিআই ব্যবস্থাকে আরও সরলীকরণ করার একটি টুল উদ্ভাবন করেছেন, এটাই তার কোম্পানির মূল পণ্য ও সেবা। এই টুল অন্যান্য সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের নিজস্ব এপিআই তৈরির কাজকেও সহজ করেছে বলে জানিয়েছে পোস্টম্যান ইঙ্ক।
আস্থানা সিএনএন বিজনেস'কে জানান, "বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও দেখেছি, এপিআই জটিলতা সফটওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হয়ে ওঠে। সেই বাঁধা দূর করাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য।"
পোস্টম্যান এখন ভারতীয় সাস ইউনিকর্নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি, কোম্পানির সার্বিক মূল্যায়ন এখন ৫৬০ কোটি ডলার।
সূত্র: সিএনএন