তালেবান আসার আগেই কয়েক কোটি ডলার সরায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কিন্তু টাকাগুলো কোথায়?
তালেবান ক্ষমতা দখলের কয়েক সপ্তাহ আগেই আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি ডলার সরিয়ে ফেলা হয়। আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক দাতাদের জন্য নির্মিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
কাবুল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আগে থেকেই দেশটিতে নগদ অর্থের তীব্র সংকট দেখা দেয়। সম্প্রতি ডেইলি মেইলের হাতে আসা দুই পৃষ্ঠার সংরক্ষিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেন দেশটির জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা।
প্রতিবেদনে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে থাকা সাবেক কর্মকর্তাদের সমালোচনা করা হয়। তালেবানের আগমনের মাসখানেক আগে থেকেই ব্যাংক কর্মকর্তারা অস্বাভাবিক পরিমাণে বিপুল ইউএস ডলার নিলামে তোলার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ প্রাদেশিক শাখা ব্যাংকগুলোতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, "কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংক এখন অর্থ লেনদেনের আবেদন পূরণে ব্যর্থ। এর মূল কারণ তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগেই ব্যাংকে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা।"
প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ জুন থেকে ১৫ আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় বৈদেশিকা মুদ্রার ডিলারদের কাছে 'উল্লেখজনকহারে উচ্চ' দেড় বিলিয়ন ডলার নিলামে তুলে। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান শাহ মেহরাবি নিলামে ৭১৪ মিলিয়ন ডলার বিক্রির কথা জানান।
তাহলে টাকা কোথায় গেল?
আগস্টে তালেবান দ্রুততম সময়ে একের পর এক প্রদেশ দখল করে কাবুলে অগ্রসর হতে থাকলে আশরাফ গনি দেশ ছাড়েন। মার্কিন সমর্থিত আফগানিস্তানের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট চার গাড়ি এবং এক হেলিকপ্টার ভর্তি অর্থ নিয়ে দেশ ছাড়েন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তবে, চলতি মাসের শুরুতে আশরাফ গনি কয়েক মিলিয়ন ডলার নিয়ে দেশ ছাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। দুবাইয়ে অবস্থানকালে তিনি বলনে, দেশের মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন।
প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা ছাড়াই আশরাফ গনির দেশ ছাড়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, দেশের স্বার্থেই গনি সরকার 'যুদ্ধ' না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ
কাবুল পতনের পরদিনই দেশ ছাড়েন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আজমল আহমাদি। তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ইমেইল ও অন্যান্য মাধ্যমে তাকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় আহমাদি জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি তার সর্বোত্তম চেষ্টাই করেছিলেন। অর্থ সংকটের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দের দিকে আঙ্গুল তুলেন।
তিনি আরো বলেন, তালেবানের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সফলভাবে দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করেছে। এছাড়া, কর্মীদের পেছনে ফেলে যেতে তার ভালো না লাগলেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থেই তিনি দেশ ছাড়েন বলেও জানান।
রিজার্ভের কোনো অ্যাকাউন্ট থেকেই অর্থ চুরি যায়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান শাহ মেহরাবি তালেবান আসার পূর্বেও ব্যাংক তদারকির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এখনও এই পদে কর্মরত রয়েছেন। ব্যাংকের পদক্ষপের পক্ষে সাফাই গাইতে তিনি বলেন, কেন্দ্রী ব্যাংক স্থানীয় আফগান মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে চেয়েছিল।
অর্থ সংকটের প্রমাণ আফগানিস্তানের শহরগুলোতে ব্যাংকের সামনে দাঁড়ানো মানুষের লাইন দেখলেই বোঝা যাবে। কয়েক ঘণ্টার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তারা জমানো সঞ্চয় থেকে ডলার তুলতে এসেছেন। অন্যদিকে, অর্থ উত্তোলনের সীমা কঠোরভাবে বেধে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মার্কিন সমর্থিত সরকারের পতনের আগেই দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত ছিল। কিন্তু, পুনরায় তালেবানের আগমন ঘটার পাশাপাশি দেশের বাইরে রিজার্ভ আটকে যাওয়ায় গভীর সংকটে পড়েছে আফগান অর্থনীতি।
ময়দার মতো আফগানদের প্রধান খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। শীত আসার মুখে লাখো মানুষ অনাহারে দিন কাটানোর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি।
বন্ধ হয়েছে বৈদেশিক অনুদান
পূর্ববর্তী সরকারের সময় প্রায় তিন মাস অন্তর ২৪৯ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পেত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১০০ ডলারের নোটভর্তি বাক্সগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে রাখা হত বলে জানয়েছে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তি।
তালেবানের সঙ্গে বিদেশি শক্তিগুলো সরাসরি কোনো চুক্তিতে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ায় সেই সাহায্য আসা বন্ধ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাহায্য বণ্টনের কাজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক করে থাকায় আফগানিস্তানে তাদের ভূমিকা অসীম। বুধবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায় দেশে বৈদেশিক অর্থের সংকট সমাধানে ব্যাংক নতুন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে নতুন এই পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা কোনো তথ্য দেয়নি।
প্রকট অর্থ সংকটের কারণে তালেবান সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ মৌলিক কার্যক্রম পরিচালনাতেও হিমশিম খাচ্ছে। কয়েক মাস ধরেই কোনো বেতন পাচ্ছেন না অনেকে।
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে যাওয়ার পরেই দেশের বাইরে থাকা ৯ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে যায়। ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ভোল্টে ছাড়া অন্য কোনো অর্থই ছিল না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, "১৫ আগস্ট নাগাদ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৫০ বিলিয়ন আফগানি মুদ্রায় (৫৬৯ মিলিয়ন ডলার) গিয়ে পৌঁছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা মেহরাবি জানান, 'অবচয় এবং মুদ্রাস্ফীতি কয়ামাতেই ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা নিলামে তুলে"।
প্রাদেশিক শাখায় রিজার্ভ স্থানান্তর
প্রতিবেদনে প্রাদেশিক শাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ স্থানান্তর করে সেগুলো ঝুঁকিতে ফেলা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। কেননা, তালেবান ২০২০ সালের শেষ থেকেই প্রাদেশিক অঞ্চলগুলো তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
২০২০ সালের প্রাদেশিক শাখাগুলোতে প্রায় ২০২ মিলিয়ন ডলার অর্থ রাখা হয়। অথচ, ২০১৯ সালে এই পরিমাণ ছিল ১২.৯ মিলিয়ন ডলার।
প্রাদেশিক কিছু শাখা থেকে অর্থ চুরির খবর আসার কথাও উল্লেখ কর প্রতিবেদনটি। তবে, কী পরিমাণ অর্থ গায়েব হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি।
মেহরাবি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর তিনটি শাখা থেকে অর্থচুরির ঘটনা তদন্ত চলছে। তবে, এগুলোর তালেবান জড়িত নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
- সূত্র: ডেইলি মেইল