তীব্র বিপর্যয়ের মুখে আফগানিস্তানের ব্যাংকিং খাত
তালেবানদের ক্ষমতা দখলের প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও আফগানিস্তানে এখনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে। ফলে বহু মানুষকে নগদ অর্থ ব্যতীত দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
গত ১৫ই আগস্ট তালেবান কর্তৃক কাবুল দখল ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই রুদ্ধ হয়ে আছে কাবুলের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর গত ২৫শে আগস্ট দেশটিতে ব্যাংক খোলার ঘোষণা দেয়া হয়; শত শত মানুষ তখনই নগদ অর্থের জন্য ব্যাংক ও এটিএম বুথগুলোর সামনে ভিড় করতে শুরু করে।
কিন্তু ব্যাংক খুললেও আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ঘাটতি থাকার কারণে অধিকাংশ সেবাগ্রহীতাই টাকা তুলতে পারেন নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, "কারও হাতেই টাকা নেই"। নিরাপত্তার স্বার্থে এই ব্যাংক কর্মকর্তা তার পরিচয় প্রকাশ করেন নি।
তিনি আরও বলেন, অনেক পরিবারের হাতে প্রতিদিন চলার মতো অর্থটুকু নেই; তাছাড়া অনেকের চেক ফিরিয়ে দিয়েছে ব্যাংক।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে মারাত্মক অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরী হয়েছে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের অর্থনীতি বৈদেশিক মুদ্রা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল- কিন্তু তালেবানের হাতে কাবুল পতনের পর থেকে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানে তাদের সহায়তা স্থগিত রেখেছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, আফগানিস্তানের জনসাধারণের ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ অর্থই অনুদান হতে আসে।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ আফগান সেন্ট্রাল ব্যাংকের স্বর্ণ এবং ফেডারেল রিজার্ভে নগদ ৭০০ কোটি ডলারের প্রবেশাধিকার আটকে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও আফগানিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৫ কোটি ডলারের তহবিল আটকে দিয়েছে।
তালেবানের দখলে চলে যাওয়ায় দিন দুয়েক আগে আফগানিস্তানে চলমান প্রকল্পগুলোতে তহবিল স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংকও।
এককথায়, বিরাট অর্থনৈতিক ধাক্কার সম্মুখীন হতে চলেছে দেশটি।
তালেবানের আদেশক্রমে অন্যান্য নানা পরিষেবা চালু করা হলেও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, ক্যাশ ঘাটতি থাকার কারণেই আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো এখনও বন্ধ।
আফগান অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট একজনের ভাষ্যে, "মানুষের হাতে কার্ডের স্তুপ জমেছে অথচ কেউ টাকা উত্তোলন করতে পারছেনা। ব্যাংকগুলো পরিপূর্ণভাবে চালু হওয়া মাত্রই সবাই বুঝবে যে, এই সিস্টেমটা আদতে কতটা নাজুক"।
অস্তিত্ব সংকটে আফগান ব্যাংকিং খাত
বর্তমান পরিস্থিতি আফগান ব্যাংকিং খাতের বড় ধরনের বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত ২৩ আগস্ট আফগান-আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্সের পাঠানো একটি মেমোতে লেখা ছিল, "আফগানিস্তান এবং দেশটির ব্যাংকিং খাত অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে; যেকোন মুহূর্তে এই খাতের পুরোপুরি পতন ঘটবে"।
আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিপুল বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সূত্র জানিয়েছে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মচারীই কর্মস্থলে ফেরার অনুমতি পায়নি।
"আমার সহকর্মীরা উদ্বিগ্ন, তারা জানে না কী ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে"।
আফগান-আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্সের পাঠানো মেমোতে আরও উল্লেখ ছিল যে, ২৩ আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ব্যাংকিং শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের কোন আবেদনে এ সময় সাড়া দেয়া হয় নি।
পরবর্তীতে তালেবানরা হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করে বলে কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নতুন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর সম্পর্কে বেশিকিছু জানা যায় নি। তার জীবনবৃত্তান্ত বা আফগান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার মতো তার কোন প্রশিক্ষণ আছে বলে জানা না গেলেও, তিনি যে একজন অনুগত তালেবান কর্মী সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই!
আফগানিস্তানের মতো নগদভিত্তিক রাষ্ট্রে, হাতে নগদ অর্থ ছাড়া মানুষের জীবন পরিচালনা করা রীতিমত এক দুঃস্বপ্ন।
হাতে থাকা কাগুজে মুদ্রা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকায় আফগান ব্যাংকিং গোষ্ঠী অবিলম্বে মার্কিন সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদে প্রবেশাধিকার প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে।
২৩ আগস্টের মেমোতে আরও বলা হয়, "দ্রুত ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদের প্রবেশাধিকার দেওয়া না হলে পুরো আফগান অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে; তাছাড়া দিনের পর দিন মানুষেরা খাদ্য এবং অন্যান্য সেবা থেকে বঞ্চিত হতে থাকলে তা ক্রমশ তাদের হতাশা এবং সহিংসতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে"।
তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা
সামনে যে তালেবান সরকার গঠন হতে যাচ্ছে, তাদের জন্যও আফগানিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে চলেছে। আইএস এবং অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে।
সিএনএনকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে, দেশ ছেড়ে যাবার আগে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বদানকারী আজমল আহমাদি দেশটির আর্থিক দীনতা, নগদ ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং দেশত্যাগ করা শরণার্থীদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, "আফগানিস্তানে শুধু মানবিক সহায়তা থাকা দরকার তাই নয়, বরং আগামী দিন ও মাসগুলোতে তার মাত্রা বাড়াতে হবে"।
বিশ্বব্যাংকের মতে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক পরিবারই (৪৭%) দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।
আফগান অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, "খুব দ্রুত এই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে চলেছে"। তার ভাষায়, মানবিক সংকট সেখানে 'অনিবার্য'।
আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা আসন্ন দিনগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "আমাদের সব স্বপ্ন নিঃশেষ হতে চলেছে। আমরা একটি আশাহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি"।
- সূত্র- সিএনএন