দিল্লি দাঙ্গা: ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের খোঁজে পরিবারগুলো
ইরশাদ আহমেদ (৫৭) দিল্লির একজন দিনমজুর। গত ২০ বছর ধরে উত্তর-পূর্ব দিল্লির মুস্তফাবাদ এলাকায় বাস করছেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবারের দাঙ্গার পর আর এবাড়িতে থাকার উপায় নেই। এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ইরশাদ। ২০ বছর ধরে যেখানে থেকেছেন, ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে তার, সে বাড়ি আর 'নিরাপদ' জায়গা নয় তাদের জন্য।
ইরশাদের বাড়িটি ছিল মুস্তফাবাদের হিন্দু-অধ্যুষিত ভাগীরথী বিহার এলাকায়। দাঙ্গার পর ওই এলাকা ছেড়ে পরিবার নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত নিউ মুস্তাফাবাদ এলাকায় আত্মীয়ের বাসায় চলে যান ইরশাদ।
এই দাঙ্গায় ওলট-পালট হয়ে যায় আহমেদের পরিবারও। ব্রিজপুরী রোড এলাকার বাসিন্দা আহমেদ জানায়, এই সহিংসতার আগুন থেকে তিনি শুধু নিজের পরিবারকে 'নিরাপদ' রাখতে চেয়েছিলেন ।
হিন্দুস্তান টাইমসকে আহমেদ বলেন, 'সকাল ৭টায় চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। পরনের কাপড়টা ছাড়া সঙ্গে আর কিচ্ছু নেইনি। ভেবে দেখলাম 'নিজের' লোকের (সম্প্রদায়/ধর্ম) সাথে থাকাই নিরাপদ।'
নিজের ১৭ আর ২২ বছর বয়সের মেয়েদের এই দাঙ্গায় নিরাপদ রাখতে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে এভাবেই পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান আহমেদ।
বুধবার সকালে দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তা আর আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা যখন এ এলাকাগুলোতে টহল দিচ্ছিল, তখন এভাবেই 'নিরাপদ' আশ্রয়ের খোঁজে 'নিজেদের লোকের' কাছে ছুটেছিলেন ইরশাদ আর আহমেদরা।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার ভয়ানক দাঙ্গার মুখে পড়ে পুরানো দিল্লির বাসিন্দারা। পাথর ছুঁড়ে মারা থেকে শুরু করে দোকানপাট ভাঙচুর, ঘরবাড়ি, মসজিদ জ্বালিয়ে দেয় দাঙ্গাকারীরা। বুধবার সকালে এই এলাকার জনমানবশূণ্য রাস্তাগুলো পড়ে ছিল ইট, পাথর, অগ্নিসংযোগকারী যানবাহন, ভাঙা বোতল, টায়ার আর পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া জনতার ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে।
পুরো এলাকা থমথমে, উত্তেজনা আর ভয়ের আঁচ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছিল। দাঙ্গা-আক্রান্ত এলাকাগুলো যেমন শিববিহার, নিউ মুস্তাফাবাদ, প্রেম নগর, চমন পার্ক, ভজনপুরা, কারাওয়াল নগর এবং দয়ালপুরের এমনই পরিস্থিতি দেখা গেছে বুধবার।
সেদিন সকালে এমনই এক রাস্তা জড়োসড়ো হয়ে দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছিলেন চন্দন লাল (৬০)। সঙ্গে ৫ বছরের ছোট্ট নাতনি, ছেলে আর পুত্রবধু। পুলিশদের অনুরোধ করছিল যেন তাদের চলে যেতে দেয়।
কিন্তু ছুতার মিস্ত্রি চন্দন এতদিনের বাড়িটা ছেড়ে যেতে চাননি। ধরা গলায় বারবার বলছিলেন, 'আমাকে আমার বাড়িটা বাঁচাতে হবে তো। আমার এলাকায় একজনের বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল দাঙ্গাবাজরা। আমার বাড়িটার সঙ্গেও এমন হতে দেই কিভাবে?'
একদিন আগেই লুটপাট হয় চন্দন লালের বন্ধু সুরেশ গুপ্তের বাড়িতে। সুরেশ গুপ্ত বলেন, "দাঙ্গার পর থেকে বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। এর পরেরদিনই আমার বাড়িটা লুটপাট করে দাঙ্গাবাজরা। আমার সব শেষ, আর কিচ্ছু বাকি নেই সেখানে।'
মঙ্গলবার দাঙ্গার স্বরূপ দেখে ১৯৯২ সালের বাবরী মসজিদের কথা স্মরণ করেন চন্দন লাল। তিনি বলেন, 'এমন ধ্বংসযজ্ঞ আমি আর দেখিনি, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার সময়েও নয়।'
গোকুলপুরীর কাছে শিববিহারেও একই গল্প। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে চমন পার্কের দিকে যাচ্ছিল আসমা (৩২)। পুলিশের একটা ভ্যান তাদের নামিয়ে দিয়ে যায় চমন পার্কে।
কাছের হিন্দু অধ্যুষিত শিববিহার থেকে উদ্ধার করা হয় আরও দুইটি পরিবারকে। সেখানে এখনও সহিংসতা চলছে বলে জানায় এলাকাবাসীরা।
ক্লান্ত-শ্রান্ত আসমা মা আর ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এসে দাঁড়াল এক কলোনির বাইরে। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে কলোনির প্রবেশপথ আটকানো। এলাকাটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ মনে করে চমন পার্কের এই কলোনিতেই আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আসমা, এখানে তার ভাইয়ের এক পরিচিতজন থাকে।
মঙ্গলবার রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে করে আসমা বলেন, কেবল দুই রাতের ব্যবধানে কেমন হয়ে গেল এলাকাগুলো, লেলিহান শিখায় কেমন জ্বলে গেল বাড়িগুলো, আমি ভাবতেই পারি না। আমাদের গলির হিন্দু পরিবারগুলো আমাদের লুকিয়ে রেখেছিল যাতে দাঙ্গাকারীরা এসে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের রক্ষা করেছে হিন্দু প্রতিবেশীরাই।'