নাগরিকত্ব বিক্রির কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য হলো সাইপ্রাস, খোদ জড়িত পার্লামেন্টের স্পিকার!
বিতর্কিত পাসপোর্ট বিক্রির কর্মসূচি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সাইপ্রাস। ইতোপূর্বে, কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল- জাজিরায় দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে আন্তর্জাতিক অপরাধীদের কাছে নাগরিকত্ব বিক্রি করতে উৎসাহী, এ সংক্রান্ত প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয়।
আজ মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) দেশটির স্বরাষ্ট্র এবং অর্থ মন্ত্রণালয় আবাসন খাতে বিনিয়োগের বিনিময়ে বিদেশিদের পাসপোর্ট দেওয়ার এ কার্যক্রম বাতিল করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানিয়েছে। টুইটারে মন্ত্রণালয় দুটির নিজস্ব পেজ থেকে যা গ্রিক ভাষায় পোস্ট করা হয়। বিবৃতি অনুসারে আগামী পহেলা নভেম্বর থেকেই এটি বাতিল করা হবে।
সরকারি সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে বিবৃতিটি জানায়, 'কর্মসূচির আওতায় চলে আসা দীর্ঘদিনের দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে (অপরাধীদের) অন্যায় সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতেই- তা নেওয়া হয়েছে।'
অপরাধীদের আশ্রয় না দেওয়ার সাইপ্রাসের বিদ্যমান নাগরিকত্ব আইন লঙ্ঘন করেই এ কর্মসূচি চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব অনিয়ম গুরুতর অপরাধ হিসেবে তদন্ত করা হবে, এমন ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জর্জ সাভভিদিস।
সোমবার আল জাজিরার সর্বশেষ সাইপ্রাস পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি বিষয়ক অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি প্রকাশের পর আজ মঙ্গলবার তিনি একথা জানান।
এদিন তার কার্যলয় থেকে দেওয়া বিবৃতি জানায়, 'কয়েক ঘণ্টা আগে আগে আল জাজিরা নিউজ নেটওয়ার্ক যে অনুসন্ধান প্রকাশ করেছে, তা দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ এবং উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।'
সোমবার গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানী দল 'সাইপ্রাস পেপার্স আন্ডারকভার' শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে দেশটির একাধিক রাজনীতিবিদ সাজাপ্রাপ্ত বিদেশি অপরাধীদের পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে আগ্রহী, এমন ঘটনা তুলে ধরা হয়।
সাইপ্রাস পার্লামেন্টের স্পিকার দিমিত্রিস সিলৌরিস এবং সংসদ সদস্য ক্রিসতাকিস জিওভানিসের বিরুদ্ধে এ সম্পৃক্ততার প্রমাণও প্রকাশ করে আল জাজিরা।
সোমবারের বিস্ফোরক তথ্য দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে গণমাধ্যমটি 'সাইপ্রাস পেপার্স' নামক বিনিয়োগের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র এবং নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে পাসপোর্ট বিক্রির তথ্য প্রকাশ করে।
ওই সময়, প্রায় ১৪শ' পাসপোর্ট আবেদনের নথি আল জাজিরার তদন্তকারী সাংবাদিকদের হাতে আসে। এরমধ্যে অনেকগুলোই করেছিলেন ধনকুবের অপরাধী এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা বিভিন্ন দেশের ধনীরা।
এদের অনেকেই নিজ দেশে জালিয়াতি, দুর্নীতি, মাদক বা অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্তের আওতায় ছিলেন। সাইপ্রাসের পাসপোর্ট কিনে তারা অনেকেই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সাইপ্রাস ইইউ সদস্য দেশ হওয়ায় জোটভুক্ত যেকোনো দেশে অবাধে ভ্রমণ এবং আর্থিক লেনদেন করারও সুযোগ পান তারা। আর সাইপ্রাস নিজেদের ইইউ সদস্য দেশ হওয়ার সুবিধাটি কাজে লাগিয়েই অপরাধীদের তাদের নাগরিকত্ব কেনায় আকৃষ্ট করেছে।
এদিকে, আজ মঙ্গলবারের ঘোষণার পর পার্লামেন্ট স্পিকার সিলৌরিস জানান, তিনি আগামী ১৯ অক্টোবর থেকে সরকারি তদন্ত চলাকালে তিনি নিজ দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকবেন।
অভিযুক্ত রাজনীতিবিদেরা:
সাইপ্রিয়ট পাসপোর্ট ক্রয়ে দেশটির অর্থনীতিতে কমপক্ষে ২৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করলেই চলতো। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা করার সুবিধা দেওয়া হয় আবাসন খাতে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দুর্নীতি বিরোধী নানা আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা অনেক আগে থেকেই এ কর্মসূচির নিন্দা জানিয়ে এসেছে। ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে এর মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, বলেও জানায় তারা। কিন্তু, তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি সাইপ্রাসের প্রশাসন।
এ অবস্থায় বিলি লি এবং অ্যাঞ্জি নামধারণ করে ছদ্মবেশে গোপন অনুসন্ধানে নামেন আল জাজিরার দুই প্রতিবেদক। একজন চীনা ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি হিসেবে তারা সাইপ্রাসের পাসপোর্ট ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
পাসপোর্ট আবেদনের সময় জমা দেওয়া কাগজপত্রে তাদের মক্কেল চীনে মুদ্রাপাচারের জন্য সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন এমন কথাও উল্লেখ করা ছিল। সাইপ্রাসের বিদ্যমান আইনে এতে তাদের পাসপোর্ট পাওয়ার কথাও নয়।
তবে, যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে পূর্ব-অপরাধের রেকর্ড সাইপ্রিয়ট নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা সৃষ্টি করবে না, বলে তাদের বার বার আশ্বস্ত করা হয়।
দেশটির অন্যতম আবাসন ব্যবসায়ী এবং সংসদ সদস্য ক্রিসতাকিস জিওভানি ছদ্মবেশধারী দুই সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অর্থ বিনিয়োগ করা হলে তিনি নিজে পাসপোর্ট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন বলে, তাদের কথা দেন।
এসময় জিওভানি বলেছেন, ''এটা সহজ নয়, তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আর এধরনের সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।''
আরেক ধাপ এগিয়ে ছিলেন সংসদের স্পিকার দিমিত্রিস সিলৌরিস। তিনি ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের বলেন, ''আপনার মক্কেলের কাছে আমার বা অন্য কারো নাম প্রকাশ করবেন না। তবে তিনি নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সাইপ্রাস সরকারের সব রকম সহায়তা পাবেন- তাকে এই গ্যারান্টি দিতে পারেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সকল পর্যায়ে আমরা সাহায্য করব।''
দেশটির একাধিক শীর্ষ রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য পেশাজীবী প্রভাবশালী ব্যক্তিও এ আশ্বাস দেন। এদের মধ্যে একজন আইনজীবীও ছিলেন।
তিনি জানান, চাইলে তিনি পাসপোর্টে উল্লেখ করা নাম বদলে দিতে সাহায্য করতে পারেন। অর্থাৎ, তিনি সরাসরি জাল পাসপোর্ট তৈরিতে আইনি সহায়তা দেওয়ার কথা প্রস্তাব করেছেন।
- সূত্র: আল জাজিরা
- অনুবাদ: নূর মাজিদ