পৃথিবী জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ডেল্টা, তবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে নিয়ে যাচ্ছে সহনসীমার শেষ পর্যায়ে
বাংলাদেশসহ এশিয়ার অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে চলছে করোনাভাইরাসের মারাত্মক পুনঃবিস্তার। এ মহাদেশের অধিকাংশ দেশই দেখছে সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাবের পারিপার্শ্বিকতা। টিকাদানের নিম্ন হার ও অতিসংক্রামক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারে সার্বিক চিত্র আরও নাজুক হয়ে পড়ছে।
শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, তার সাথে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উদীয়মান ও ধনী এশীয় দেশেও সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণ সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী। তবে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ধারালো তরবারিতে সবচেয়ে ক্ষতবিক্ষত দক্ষিণপূর্ব এশিয়া; যেখানে অধিকাংশ দেশে লাগামহীন হারে বেড়ে চলেছে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা।
গতবছর এ অঞ্চলে সার্স কোভ-২ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এতোটা ভয়াবহ ছিল না। কিন্তু, এবছর দক্ষিণপূর্ব এশীয় রাষ্ট্রগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর চাপে পর্যদুস্ত; দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসা উপকরণ ও অক্সিজেনের চরম সংকট।
বাধ্য হয়েই পুনরায় লকডাউনে ফিরেছে দেশগুলো। বন্ধ রয়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় প্রভাবিত নাগরিকদের ওপর আবারো আরোপিত হয়েছে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা।
নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং কাজ করার ক্ষমতার উপর আরো বেশি সীমাবদ্ধতা আরোপের ফলে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে জনমনের ক্ষোভ-অসন্তোষ; ইতোমধ্যেই সরকারের মহামারি ব্যবস্থাপনায় গাফিলতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়।
গত ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বিক্ষোভ- সংঘাতে অস্থির মিয়ানমারে সামরিক জান্তার দমনাভিযানে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। টিকাদানও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের মতো কিছু ধনী দেশ তাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নাগরিককে টিকা দেওয়ার পরও ডেল্টা ধরনের কারণে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি লক্ষ্য করছে। সে তুলনায় দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ ভিয়েতনামে মাত্র ১ শতাংশেরও কম মানুষকে সম্পূর্ণরূপে টিকাকরণ করা হয়েছে। থাইল্যান্ডে যার পরিমাণ ৫ শতাংশ এবং ফিলিপাইনে ৭.২ শতাংশ। মহামারিতে মানবিক বিপর্যয়ের নতুন কেন্দ্রস্থল ইন্দোনেশিয়ায় এ হার ৭.৬ শতাংশ বলে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা- সাইটের সূত্রে জানা যায়।
এদিকে মহামারি হানা দেওয়ার ১৮ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও অতিসংক্রামক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে বিভিন্ন জাতির স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা প্রকটভাবে সামনে আসছে। বিধিনিষেধের মাধ্যমে এর আগে এসব দেশের অনেকে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে সীমিত রাখতে সম্ভব হলেও, ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আবির্ভাবের পর টিকাহার কম থাকায় শেষ রক্ষা হয়নি।
ভিয়েতনাম:
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক সফলতার সঙ্গে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে মোড় নেওয়া সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে ভিয়েতনামে।
বিমানবন্দরে যাত্রীদের কঠোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন থেকে শুরু করে দেশব্যাপী কড়া স্বাস্থ্যবিধি চালু করায় গত বছর ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে প্রশংসিত হয়েছিল ভিয়েতনাম। গত ১৮ মাসের অধিকাংশ সময় তাই নিশ্চিন্তেই ছিলেন হো চিন মিনের দেশবাসী।
জনজীবনে স্বাভাবিকতাসহ ছিল অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে এসময় ভিয়েতনামের অর্থনীতি ২.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে।
কিন্তু, গত এপ্রিলের পর থেকেই নাটকীয়ভাবে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে। গত বুধবার ভিয়েতনামে মোট ৭,৬২৩ জনকে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত করা হয়, গত রোববারে দৈনিক শনাক্তের এ সংখ্যাটি ছিল ৮,৬২০ জন।
নতুন আক্রান্তদের মধ্যে অশিকাংশই ছিলেন হো চি মিন নগরীর বাসিন্দা।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিতির তথ্যানুযায়ী, এপর্যন্ত ভিয়েতনামে মোট এক লাখ ৭৭ হাজার ৮১৩ জন করোনা আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে, যার ৮৫ শতাংশই শনাক্ত হন শুধু মাত্র গত মাসে। এছাড়া, মোট ২,৩২৭ মৃত্যুর অর্ধেকও হয় গত মাসেই।
এ বাস্তবতায় রাজধানী হ্যানয় ও হো চি মিন সিটিতে সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউন দিয়েছে সরকার। রোগীর চাপ মোকাবিলায় স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
তবে প্রাদুর্ভাবের কারণে একইসাথে টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং টিকাদান বৃদ্ধির চাপ মোকাবিলা করছে কর্তৃপক্ষ। ভিয়েতনামের ৯ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এপর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে টিকা পেয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া:
ভারতকে ছাড়িয়ে এশিয়াতে মহামারির কেন্দ্রস্থল এখন ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ জনসংখ্যার এ দেশে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি মানুষ করোনা পজিটিভ শনাক্ত হচ্ছেন।
মহামারি শুরু পর এপর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন সাড়ে ৩৫ লাখ, যার মধ্যে ১২ লাখ শনাক্তের ঘটনা রেকর্ড হয় গেল মাসে।
গত বুধবার প্রথমবারের মতো এক লাখের বেশি মৃত্যু ছাড়িয়ে যায় ইন্দোনেশিয়ায়, ভারতের পর এশিয়ার দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে অনাকাঙ্ক্ষিত এ স্থান পেয়েছে দেশটি।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুধবার ১,৭৪৭ জনের মৃত্যুর কথা জানায়।
লাগামহীন ভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য সেবা খাত ভেঙ্গে পড়ার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাবে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে অবশ্য মনে করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়ানক।
স্থানীয় একটি স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী জাকার্তার এক কোটির বেশি অধিবাসীর অর্ধেকই কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছেন।
দেশটিতে গোরস্থানেও আর জায়গা নেই। শস্যক্ষেতেও করতে হচ্ছে নতুন কবরের জায়গা। স্বাস্থ্যকর্মীরাও ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুরুতেই কঠোর লকডাউন না দেওয়ার পরিণাম এখন ভুগছে ইন্দোনেশিয়া।
গত সোমবার ইন্দোনেশীয় সরকার সর্বোচ্চ মাত্রার বা লেভেল ফোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে নগরাঞ্চলে। রাজধানী জাকার্তাসহ প্রধান দ্বীপ জাভা ও বালিতে কড়াকড়ির মেয়াদ আরও সাতদিন বাড়ানো হয়।
তবে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, কিছু কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ, এরপর সংক্রমণ কমে আসার ইঙ্গিত দেন তিনি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, দেশটির সরকার আগামী সেপ্টেম্বরে পর্যায়ক্রমে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
মালয়েশিয়া:
দেশব্যাপী লকডাউন আরোপের পরও মালয়েশিয়ায় করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু থামার কোনো লক্ষণ নেই, বরং বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। প্রাদুর্ভাবের কারণে এক মাস স্থগিত রাখা হয়েছে পার্লামেন্ট অধিবেশন।
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে নাগরিক সমাজের। রাজধানী কুয়ালালামপুরে করোনাভাইরাস বিধিনিষেধ অম্যান্য করে মহামারি মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে দাবি তুলে বিক্ষোভে অংশ নেন শত শত মানুষ। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পদত্যাগও দাবি করেন।
গত সোমবার মুহিউদ্দিনের পদত্যাগ দাবি করে বিরোধী আইনপ্রণেতারাও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সমাবেশ করেছেন।
মালয়েশিয়ার চলমান রাজনৈতিক সংকটের বাস্তবতায়- বেড়ে চলা মৃত্যু, টিকাদানের নাজুক হাল এবং অর্থনৈতিক দৈন্যদশা জনমানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে। এসব কিছু মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ায় মুহিউদ্দিনের এক বছর বয়সী সরকার পতনের মুখে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে ধর্মঘটে অংশ নেন শত শত মালয়েশীয় চিকিৎসক। তারা হাসপাতালের নাজুক হাল নিয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, তারা সাধ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। শয্যা ও ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ফুরিয়ে আসলেও সরকারের তাতে মাথাব্যথা নেই।
মালয়েশিয়ায় কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার সময়েই চিকিৎসকদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়।
সংক্রমণের দৈনিক সংখ্যাতেও হচ্ছে রেকর্ড। বুধবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মোট ১৯,৮১৯ জঙকে শনাক্ত করার তথ্য দেয়, এক মাস আগে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। দৈনিক মৃত্যুও গড়ছে রেকর্ড, বুধবার প্রাণহানি হয় ২৫৭ জনের।
থাইল্যান্ড:
গত বছরের জানুয়ারিতে চীনের বাইরে প্রথম যে দেশে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, সে দেশটি হলো থাইল্যান্ড। সফল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থার কল্যাণে ২০২০ সালে থাইল্যান্ডও সংক্রমণের সংখ্যা কম রাখতে পেরেছিল।
এবছর অবশ্য আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দেশটি। গেল ডিসেম্বরে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার পর এখন ডেল্টা ভেরিয়েন্টের তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে দেশটি।
বিস্ফোরণ ঘটেছে দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায়। বুধবার থাই কর্তৃপক্ষ ২০,৯২০ জনের নতুন করে সংক্রমিত হওয়া এবং ১৬০ জনের মৃত্যুর কথা জানান।
সক্ষমতার চাইতে বেশি হাসপাতালের শয্যা চাহিদা দেখা দেওয়ায় এখন হাসপাতালে রোগী আসা কমাতে চাইছে থাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য ৪০০ জন চিকিৎসক ও নার্সের একটি দলকে এবার শহুরে বস্তি এলাকায় পাঠাচ্ছে ব্যাংকক। স্বাস্থ্য কর্মীদের দলটি আড়াই লাখ বস্তিবাসীর করোনা টেস্ট করাসহ শনাক্তদের আইসোলেশনের বিশাল চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন।
মিয়ানমার:
মিয়ানমারের দূরাবস্থা যেন বলে শেষ করবার মতো নয়। মহামারি আর সামরিক অভ্যুত্থান এ দুইয়ের বোঝা জগদ্দল পাথরের মতো দেশটির বুকে চড়ে বসেছে। অক্সিজেনের ব্যাপক সংকটে প্রাণ হারাচ্ছেন রোগীরা। একটি সিলিন্ডারের সন্ধানে উন্মাদের মতো ছুটছেন রোগীর স্বজনেরা।
দেশটির চিকিৎসকরা জানান, অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, কারণ হাসপাতালে গেলে অক্সিজেন না থাকায় বা শয্যার অভাবে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি এসব স্থাপনায় কর্মী সংখ্যাও অপ্রতুল।
জাতিসংঘের একটি হিসাব অনুসারে, দেশটির মাত্র ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্য অবকাঠামো সচল অবস্থায় রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দেশটিতে গত জুনে ১০০ জনের দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা এখন ৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। জান্তা সরকারের দেওয়া হিসাবেই মৃত্যু হয়েছে ১০,৩৭৩ জনের। তবে প্রকৃত সংখ্যা বহুগুণ বেশি হওয়ার অনুমান করছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ।
- সূত্র: সিএনএন