বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ কী?
চীনে দেখা দিয়েছে এক অভূতপূর্ব বিদ্যুৎ সংকট। দেশটির উত্তরাঞ্চল জুড়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে জনজীবন। কারখানার ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বেশ কয়েকজন শ্রমিক।
আবার হাসপাতালেও জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যেই। বিদ্যুৎ সংকটে লাখ লাখ মানুষ অন্ধকারে বসবাস করছে; সেইসঙ্গে পানির সংকটও দেখা দিয়েছে একটি প্রদেশে।
এদিকে, যুক্তরাজ্যেও শক্তি সংকটের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। গত সপ্তাহে দেশটির অনেক রাজ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়তে বাড়তে হয়েছে আকাশচুম্বী।
পুরো ইউরোপজুড়েই তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে।
অন্যদিকে, শীত আসার আগেই যুক্তরাষ্ট্র গ্যাস ও কয়লার চাহিদা এবং উৎপাদনের মাঝে সামঞ্জস্যতা ধরে রাখতে হিমশিম খেতে শুরু করেছে।
তাহলে, বৈশ্বিক এই শক্তির সংকটের পিছনে কারণ কী? এবং এই সংকট কত বড় আকার ধারন পারে?
প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমত, আমরা এই সঙ্কটে পড়লাম কীভাবে? এর জন্য মহামারি কতটা দায়ী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তির ঘাটতির পিছনের কারণগুলো বহুমাত্রিক। এগুলোর মধ্যে অনেকেই কোভিড-১৯ মহামারিকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন।
মহামারির কারণে দীর্ঘদিন দেশগুলোয় শক্তি চাহিদা কম ছিল। কিন্তু এখন পুনরায় সব দেশের কল কারখানা পুরোদমে চালু হওয়ায় বিশ্বব্যাপী শক্তির চাহিদা বেড়েছে; যা এই সংকট তৈরিতে অবদান রাখছে।
জীবাশ্ম জ্বালানীর উপরেই এত নির্ভরশীলতা কেন? "গ্রিন এনার্জি" বা সবুজ শক্তি কি এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে?
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গত পাঁচ থেকে দশ বছর যাবত বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে মনোনিবেশ করেছেন বিনিয়োগকারী।
কিন্তু বাস্তবতা হল, এখনও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তেল, গ্যাস এবং কয়লার মতো গতানুগতিক শক্তির উৎসের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে ওঠার সময় এখনও আসেনি। কারণ এই উৎসের উন্নয়ন কার্যক্রম এখনও চলমান।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে বিনিয়োগের ফলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে দেখা দিয়েছে বিনিয়োগের অভাব; আর এই সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে বর্তমান সংকট।
এর অর্থ কি তাহলে পরিবেশ দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে?
ব্যাপারটি বিশ্লেষকদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়।
পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন (ওপেক) -এর মহাসচিব ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করা হবে "চরম ভুল" সিদ্ধান্ত। কারণ পুরো বিশ্ব নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকলেও, আগামী কয়েক বছর তেলের চাহিদা বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
অপরিশোধিত তেলের দাম ইতোমধ্যে ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলার ছাড়িয়েছে, যা বিগত তিন বছরে সর্বোচ্চ।
কয়লা এবং গ্যাস সম্পর্কে কী বলা যায়?
কয়লা, গ্যাস এবং পানি সংকট ইউরোপজুড়ে শক্তির দাম বাড়িয়ে চলেছে। এদিকে, চীনের পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ ধরে রাখার চেষ্টা করছে, যা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে দূষনকারী এই জীবাশ্মের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় চীন সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার করে থাকে। দেশটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা উৎপাদনকারী; তবে সরবরাহ সংকট চীনের বিদ্যুৎ এবং কারখানার উৎপাদনকে বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে।
চীনে জ্বালানি সংকটের পেছনের কারণ কী?
বিভিন্ন কারণে চীনে এই সংকট দেখা দিয়েছে। দেশটিতে বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই কয়লার দাম বাড়তে থাকলেও কোম্পানিগুলো ভোক্তা এবং কারখানার অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারছেনা। অর্থাৎ কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা অর্থ হারাচ্ছে এবং বর্তমান চাহিদা মেটাতে উৎপাদন ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্রেক্সিটের সঙ্গে এই সংকটের সম্পর্ক কী?
গুদাম থেকে স্টেশনে পেট্রোল জ্বালানি পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম হলো লরি। কিন্তু যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে, ইইউ নাগরিকরা আর ব্রিটেনে ভিসামুক্ত যাতায়তের সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে ব্রিটেনে জ্বালানি সরবরাহকারী লরি চালকদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে, যা দেশটির শক্তি সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তিনি ১০ হাজার বিদেশী লরি চালকে অস্থায়ী ভিসা ইস্যুর মাধ্যমে নিয়োগ দেবেন। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে এই সংকটের সমাধান হবেনা। কারণ দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ চালকের অভাব রয়েছে এবং নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রশিক্ষণ দিতেও সময় লাগবে।
এছাড়া অস্থায়ী ভিসাগুলোর মেয়াদ এই বছরের শেষের দিকেই শেষ হয়ে যাবে। কারণ এগুলো খুব অল্প সময়ের জন্য ইস্যু করা হয়।
তাই ব্রিটিশ সরকার ট্রাক চালানোর জন্য তার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রস্তুত রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কী অবস্থা?
সামনের শীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেও প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকটের মুখে পড়তে পারে। মহামারির সময়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব এবং চলমান শ্রমিক সংকটের কারণে, তেল খাতে শ্রমিক নিয়োগ আরও কঠিন হয়েছে উঠেছে দেশটিতে।
বুধবার ডালাস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫১ শতাংশ তেল ও গ্যাস কোম্পানি জানিয়েছে, শ্রমিক নিয়োগে তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ৭০ শতাংশ জানিয়েছে, তারা যোগ্য কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না। ৩৯ শতাংশ জানিয়েছে, শ্রমিকরা বেশি মজুরি দাবি করছে, যা কোম্পানির সাধ্যের বাইরে।
তাহলে কী হতে চলেছে পরবর্তীতে?
বিশ্লেষকদের মতে, সেটা এখনও দেখার বাকি। বর্তমান শক্তির চাহিদা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ এখন অনেকটা সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুয়ের মাঝে অসামঞ্জস্যই বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ।
উদাহরণস্বরূপ চীনের কথাই বলা যেতে পারে। দেশটিতে বর্তমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। অথচ বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন হ্রাসে চীন সরকার ২০৬০ সালের একটি সময়সীময়া নির্ধারণ করেছিল। অর্থাৎ, এ সময়ের মধ্যে চীন বিশ্বের কাছে কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শক্তির দাম বৃদ্ধি পুরো বিশ্বকেই প্রভাবিত করবে এবং জীবনের সবক্ষেত্রেই এটি প্রভাব ফেলছে সক্ষম। কারণ, শক্তি সম্পদের সঙ্গে প্রতিদিনের জীবন চলা ঘনিষ্টভাবে জড়িত। আর এই সংকট নিশ্চিতভাবেই নাগরিক অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারের উচিত হবে তাদের নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া, যেনো কিছুটা হলেও এই সংকট মোকাবেলা করা সহজ হয়।
- সূত্র: আল জাজিরা