ভারতেও টুইটারের আপন নীতিতে অটুট থাকা উচিৎ
দেশে দেশে কট্টরপন্থী রাজনীতির প্রচার আর অপপ্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে অনলাইনে সামাজিক মাধ্যম। প্রযুক্তির নতুন এই অবদানকে তারা অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের মৌলিক সংগঠনের বিরুদ্ধেও কাজে লাগান। এনিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনাও কম সহ্য করেনি সামাজিক মাধ্যম। কিন্তু, ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা ভেঙ্গে দেয় সকল ধৈর্যের গণ্ডি। টুইটার কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গেই বিপজ্জনক এই প্রেসিডেন্টকে তাদের প্ল্যাটফর্মে চিরতরে নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়।
ভারতের ডানপন্থী রাজনীতি নিয়ে কিন্তু সামাজিক মাধ্যমটি এতোটা সচেতনতা দেখায়নি। সে মাসুল কী এবার তারা পেতে চলেছে?
চলতি মাসেই ভারতের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী টুইটারের পরিবর্তে নিজ সমর্থকদের কো (Koo) ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এটি টুইটারের আদলে মাইক্রো ব্লগিং- এর জন্যে তৈরি একটি ভারতীয় প্ল্যাটফর্ম। ত্যাগের এই আহ্বান মন্ত্রী মহাশয় আবার টুইট করেই জানিয়েছিলেন।
ঘটনাটি থেকে টুইটার কর্তৃপক্ষের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। ভারতসহ বিশ্বের যেসব দেশে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি চাপের মুখে রয়েছে; সেখানে তাদের নিজস্ব নীতিতে সহজে ছাড় দেওয়া মোটেই উচিৎ নয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাও টুইটার বর্জনের ডাক দিয়েছেন, তা নিয়ে রাখঢাকও করেননি। আসলে যা প্রকাশ্য যুদ্ধের ঘোষণা। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় রাজনীতির নানা উত্তপ্ত ইস্যুর মতোই টুইটার বর্জনের ডাক এসেছে চলমান কৃষক আন্দোলনের সূত্রে। টুইটারে কৃষকদের পক্ষে দেশবাসীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশসহ ভিনদেশি অধিকার কর্মীদের খোলামেলা সমর্থন বিজেপি ও তার সমর্থকদের স্বভাবতই ক্ষুদ্ধ করেছে।
ইতোপূর্বে, টুইটারে 'ফার্মার জেনোসাইড' বা কৃষক গণহত্যার মতো হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়। এই স্লোগানের আওতায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভুলভাবে কৃষক বিরোধী অবস্থানে দেখানো হচ্ছে, বলে দাবি করে বিজেপি। তাদের মতে, এটি সামাজিক গণমাধ্যম অবাধে ব্যবহার করে চালানো নিছক অপপ্রচার। তখন থেকেই সরকারের কৃষি বিলগুলোর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া অধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনের অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধে বর্জনের ডাক দিয়ে টুইটার ইঙ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বিজেপি শুধু ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট নয়, এমনকি মুক্তমত চর্চাকারী গণমাধ্যমের আনুষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে চায়। এজন্য সরকারিভাবে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নেইম্যান ফাউন্ডেশন থেকে সাংবাদিক সততার জন্যে পুরস্কার জয়ী একটি ম্যাগাজিনও রয়েছে। বিরোধী কিছু রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট সাংবাদিকরাও আছেন।
টুইটার প্রথমে এই দাবি মেনে নিয়ে অ্যাকাউন্টগুলো সাময়িক বন্ধ রাখে, তবে পরবর্তীতে তারা কিছু অ্যাকাউন্ট সচল করে। আর তাতেই ক্রোধে জ্বলছে বিজেপি। সিদ্ধান্ত না বদলালে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ভারতে নিযুক্ত টূইটার নির্বাহীদের সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার হুমকি। দেশটির প্রযুক্তিমন্ত্রী চাপা হুঁশিয়ারি দিয়েই বলেছেন যে, ভারতে সামাজিক মাধ্যমের কোম্পানিগুলো ব্যবসার জন্যে আসতে পারে, আমরা তাদের অভিবাদনও জানাই। কিন্তু, তাদেরকে অবশ্যই ভারতীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
এসব হুমকি-ধামকির চাপে কোম্পানিটির মাথানত করা চলবে না। ভারতের বাজারে টুইটারকে সহজে পরিত্যাগ করাও সম্ভব নয়। কারণ; টুইটারের পক্ষে আছে তিনটি শক্তি- আইন, আদর্শ এবং পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত সংযোগের সুবিধা।
প্রথমেই জেনে রাখা ভালো, সরকারি নির্দেশ ভারতীয় আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বলে টুইটার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য। সরকারি অনুমোদনে কোনো ভারতীয় নাগরিকের ইন্টারনেট বিচরণ নিষিদ্ধ করতে হলে; তার জন্যে লিখিত আদেশে যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে হয়, যাতে এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আদালতে রিট দায়ের করতে পারেন। তার বিপরীতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে, যা বিদ্বেষপূর্ণ এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া। গণতান্ত্রিক সংবিধানের ব্যাখ্যায়, অনলাইনে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত।
আরেকটি আইনে অবশ্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতার জন্যে বিপজ্জনক রাজনৈতিক মতামত অনলাইনে সীমিত করার বিধান রয়েছে। এবং বিতর্কিত সেই আইনটি পাস করার সময়েই নাগরিক অধিকার কর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, এর ফলে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো সরকারি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার খুব বেশি সুযোগ পাবে না। তাই এটি টুইটারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের হুমকি কোনো অবাক করার মতো ঘটনা নয়, বরং সেই উদ্দেশ্যেই আইনটি তৈরি হয়েছে। তারপরও, গণতান্ত্রিক সংবিধান অনুসারে টুইটার ভারতীয় আইনের আওতাতে যথেষ্ট যুক্তি দেখাতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দেশ অনুসারে সম্পূর্ণ বিপরীত রীতিতে চলতে পারে না। বরং সকল স্থানেই তাদের একটি আদর্শ মানদণ্ড রাখা উচিৎ। বিশ্বায়নের যুগে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো; বিশেষ করে, প্রযুক্তি খাতের বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম গণতান্ত্রিক মতচর্চার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসা করে। একেক বাজারে একেক নীতি নিলে তাদের বৈশ্বিক ভোক্তারাই বিমুখ হয়ে পড়বে।
অতীতে পশ্চিমা অনেক কোম্পানি নিজ দেশে সাধু সেজে, ভিনদেশে স্বৈরশাসকদের পক্ষে কাজ করেছে। সে সুযোগ আর নেই। কারণ, পুরো বিশ্বজুড়ে এসব নেটওয়ার্ক একসুতোয় গাঁথা। নিজস্ব মানদণ্ড অন্য দেশে লঙ্ঘন করলে, তার জন্যে মার্কিন সিনেটেও জবাবদিহিতার জন্যে ডাকা হতে পারে কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীকে।
ট্রাম্পও নেই, যুক্তরাষ্ট্রে এখন বাইডেন প্রশাসন। তাই ভারতে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া, এখন আগের যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সহজ নয়। কারণ, শতভাগ সুষ্ঠু না হলেও, ভারতে নির্বাচন সকলের জন্যে উন্মুক্ত। তবে নাগরিক অধিকার দমনের মাত্রা যে দিনে দিনে বাড়ছে, তাও অস্বীকার করা যায় না। দেশটি বয়োবৃদ্ধ অনেক অধিকার কর্মীকে জামিন ছাড়াই কারাগারে বন্দি রেখেছে। যেসব অভিযোগে তাদের আটক করা হয়- তা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি সংস্থা তৈরি করেছে বলে অভিমত মার্কিন প্রযুক্তি বিশারদদের। চাপের মুখে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার গোষ্ঠী। নিরপেক্ষ গণমাধ্যমগুলকে বন্ধ করা হয়েছে অর্থপাচারের অভিযোগে।
অধিকার লঙ্ঘনের এই ধারাবাহিকতা নতুন মার্কিন প্রশাসনকে টুইটারের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করবে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। তাই ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে মার্কিন কোম্পানির উপর অন্যায্য চাপ প্রয়োগ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাছাড়া, ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করার যথেষ্ট সুযোগ ওয়াশিংটনের হাতেই আছে।
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গে মতামত কলামিস্ট। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।