ভারতের টিকা কর্মসূচিতে পরিকল্পনার অভাবে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা, অসন্তোষ
জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভারতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী দেশ ভারত। কয়েক দশক ধরে দেশটি সফলতার সাথে প্রান্তিক অঞ্চলের গর্ভবতী নারী ও শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সব মিলিয়ে ধারণা করা হয়েছিল, সফলতার সাথে ভারত ভ্যাকসিন বিতরণের মাধ্যমে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবে।
২২ জানুয়ারির এক বক্তব্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, "দেশের প্রতিটি প্রান্তে দ্রুত ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের আছে। ভ্যাকসিনের জন্য পুরো বিশ্ব যখন উদগ্রীব, তখন আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে স্বনির্ভর। শুধু তাই নয়, ভারত বহু দেশকে ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করছে।"
শুরুর সেই প্রতিশ্রুতি মাত্র তিন মাস পরেই ফিকে হয়ে আসে। সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনাগুলোও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ১৩০ কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভারত মাত্র ২ শতাংশেরও কম জনগণকে দুই ডোজ অর্থাৎ, পরিপূর্ণভাবে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে।
দেশজুড়ে বিস্তৃত টিকাদান কেন্দ্রগুলো জানাচ্ছে যে, তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে টিকার ডোজ নেই। এমনকি, ভ্যাকসিন রপ্তানিও বন্ধ হয়ে গেছে। সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি এখন প্রায় প্রতিদিন দৈনিক সংক্রমণের নতুন রেকর্ড গড়ছে।দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় হাসপাতাল এমনকি অন্তিম ক্রিয়া ব্যবস্থাপনাতেও দেখা দিয়েছে সংকট।
সংকট মোকাবেলায় মোদির সরকার ভ্যাকসিন সরবরাহে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমেই প্রস্তুতকারকদের সাথে ভ্যাকসিনের মূল্য নিয়ে সমঝোতায় আসে। বিভিন্ন রাজ্যে ভ্যাকসিন বন্টনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের টিকাদানে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
পয়লা মে থেকে দেশটির ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ টিকা গ্রহণ করতে পারবে। রাজ্য সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য সরাসরি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকেই টিকা কিনতে পারবে। নতুন এই ঘোষণার কারণে বাজারে বিদ্যমান সংকটের মাঝেই বিনামূল্যে টিকাদানের জন্যও মরিয়া হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ।
মোদির সরকারের নতুন নীতি হলো, "মূল্য নির্ধারণ, ক্রয়, টিকাদান যোগ্যতা, মুক্ত ও নমনীয় ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা"। বিরোধী দল শাসিত রাজ্য প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি মহামারি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিয়ে রাজ্য সরকারের উপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে, ভারতের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন ভ্যাকসিনের কাঁচামাল মজুদ রাখছে। নতুন চালান আসতে সম্ভবত কয়েক মাস পেরিয়ে যাবে। মজুদ কমতে থাকায় টিকাদান কর্মসূচীর সম্প্রসারণ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
নেই আলোচনা:
ছত্তিশগড়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী টিএস সিং দেও বলেন, "নিজ নিজ রাজ্যের জন্য ভ্যাকসিন ক্রয়ের বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার আগে রাজ্য সরকারগুলোর সাথে কোনো আলোচনা করা হয়নি। আমাদের অর্থনীতিতে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজ্য হিসেবে মুক্তবাজার থেকে ভ্যাকসিন কিনতে হবে।"
সাম্প্রতিক সময়ে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্ব বাড়ছে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের। ফলে, দেশটির বাড়তে থাকা সংক্রমণ অর্থনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে কোভিড নিয়ন্ত্রণ এবং পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাপনাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে মহামারির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে এই রাষ্ট্র।
সিডনির ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের জৈব-নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক রাইনা ম্যাকইন্টায়ার বলেন, "টিকাদান কর্মসূেচির ওপর সবথেকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। মানুষকে টিকা দেওয়া হলে নতুন স্ট্রেইনের আবির্ভাব নিয়েও চাপ কমবে।"
সতর্কবার্তা:
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণের পরিবর্তে বিশ্বকে ভারতের সাহায্য করার সক্ষমতার প্রদর্শনেই ব্যস্ত ছিলেন।
২৮ জানুয়ারি ভারতে কোভিড শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৮,৮৮৫। সেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ভার্চুয়াল এক সম্মেলনে যুক্ত হয়ে বলেন, ভারত অন্যান্য দেশকে ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করবে। তিন মাস পর ২৯ এপ্রিল ভারতে দৈনিক শনাক্ত সংখ্যা তিন লাখ ৭৯ হাজার ২৫৭। অথচ, সেরাম এবং অন্যান্য ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্রের মজুদের কারণে সৃষ্টি হতে যাওয়া ভ্যাকসিন সংকট নিয়ে সতর্ক করেছিল। ভারত তখন রপ্তানি কমিয়ে ৪৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে। অর্থাৎ, আসন্ন সংকট মাথায় রেখে এ পরিকল্পনা করা হয়নি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন টিকাদান পরিকল্পনা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন ভারতের পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব কুম্ভমেলাকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ পূণ্যার্থী গঙ্গাজলে ডুব দিতে ব্যস্ত ছিলেন। পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো চালাচ্ছিল জন-সমাগমপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা।
ভারত কোভিড-১৯ মহামারির শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছে বলে মন্তব্য করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন। এমনকি, সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ৩০ মার্চ তিনি বলেন, "পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।"
৩ এপ্রিল আসাম রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং মোদির দল ক্ষমতাসীন বিজেপির সদস্য হিমান্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, "আসামে কোনো কোভিড নেই। এখন আর মাস্ক পরিধান করতে হবে না।"
১৬ এপ্রিল ভ্যাকসিন সংকট এত তীব্র রূপ ধারণ করে যে, সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালা সরাসরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে টুইট করে যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন।
রাজ্যের উপর সৃষ্ট চাপ:
সম্প্রতি মোদি পূর্বের ভ্যাকসিন কৌশল বাতিল করে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এবারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্যাকসিনের দায়িত্ব পুরোপুরি রাজ্য সরকারের উপর চাপানো হয়। তবে, বেশ কিছু রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে টালমাতাল পরিস্থিতিতে আছে। ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানিও কার্যকরভাবে থামাতে সক্ষম হয়েছে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো এখন ভ্যাকসিনের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকছে।
মোদির নতুন ভ্যাকসিন পরিকল্পনাকে সমাধানের বদলে "চতুর রাজনৈতিক চাল" বলে উল্লেখ করেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কেরালার অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক।
বিরোধী দল কংগ্রেস চালিত পাঞ্জাবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলবীর সিং সিধু বলেন, "নতুন ভ্যাকসিন নীতি কীভাবে পরিচালনা করা হবে সে বিষয়ে কোনো সমন্বয় কিংবা পরামর্শ নেই। পুরো বিষয়টিই উপর থেকে নিচে চাপিয়ে দেওয়া।"
আরও ৬০ কোটি মানুষকে টিকা দিতে ভারত কীভাবে সরবরাহ বৃদ্ধি করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৪৫ বছরের অধিক বয়সীদের টিকাদানের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই সরবরাহ সংকট দৃশ্যমান। বুধবার থেকে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন চালু হলে আরও এক কোটির বেশি মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করায়।
অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা উৎপাদনকারী সেরাম এবং কোভ্যাক্সিন উৎপাদনকারী ভারত বায়োটেক মে'র মাঝামাঝি সময়ে রাজ্য সরকারগুলোর কাছে ভ্যাকসিন পাঠাতে পারবে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকর্তারা। তবে, নতুন করে টিকাগ্রহণে যোগ্য ১৮-৪৫ বছর বয়সীদের রেজিস্ট্রেশন বুধবার ২৮ এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে।
ভ্যাকসিনের মূল্য হওয়া উচিত শূন্য:
সেরাম এবং ভারত বায়োটেক উভয় প্রতিষ্ঠানই জানিয়েছে যে, তারা জুলাই নাগাদ ভ্যাকসিন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে। অবশিষ্ট মজুদে থাকা ভ্যাকসিন কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যগুলোকে সমানভাবে সরবরাহ করা হবে। নয়াদিল্লি রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদন ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী মে নাগাদ স্পুটনিক আসতে পারে বলে জানা গেছে। তবে তা কী পরিমাণে আসবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রও ভারতকে কাঁচামাল এবং মজুদ ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সে বিষয়েও বেশি কিছু খোলাসা করা হয়নি। এছাড়া ভ্যাকসিনের ব্যয়ভারের প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলোকে জানানো হয়েছে যে, তাদের প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য পাঁচ থেকে আট ডলার পর্যন্ত মূল্য দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান ক্রয়মূল্যের তুলনায় এই মূল্য প্রায় তিন গুণ বেশি।
ভ্যাকসিনের তীব্র চাহিদার মুখে বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) ভারত বায়োটেক ৬০০ রুপির প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম কমিয়ে ৪০০ রুপি (৫.৪ ডলার) নির্ধারণ করে। এর একদিন আগে সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালাও ভ্যাকসিনের মূল্য ১০০ রুপি কমানোর ঘোষণা দেন।
মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে জানান, তার সরকার রাজ্যের মানুষকে বিনামূল্যে টিকাদানের জন্য ৬৫ বিলিয়ন রুপি খরচ করবে। তবে, পর্যাপ্ত ডোজ না থাকায় এখনই সকল বয়সের প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকাদান কর্মসূচি উন্মুক্ত করা যাবে না।
গুটিসংখ্যক যে কয়টি দেশ বেসরকারিভাবে কোভিড টিকাদানের অনুমোদন দিয়েছে তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম। দেশটি বেসরকারি হাসপাতালে টিকার মূল্য তিন ডলার করে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রতি ডোজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে আট থেকে ১৬ ডলারে গিয়ে পোঁছেছে। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি হাসপাতালগুলো এর থেকেও বেশি মূল্য নিয়ে থাকে।
মোদি প্রশাসনের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান বলেন, "পুরো ভারত জুড়ে ভ্যাকসিনের একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। মূল্যটি হতে হবে শূন্য"।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ