ভারত কি ভ্যাকসিন উৎপাদনের বৈশ্বিক ও দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পারছে?
করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকা দেশ ভারত বর্তমানে ভ্যাকসিন রপ্তানির প্রতিশ্রুতি পূরণে হিমশিম খাচ্ছে।
দেশটির বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যে যত ডোজ পাঠানোর কথা ছিল তা আপাত স্থগিত হতে পারে, নেপালে যে বড় চালান পাঠানোর কথা ছিল তাও স্থগিত করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ঘাটতি কেন?
নোভাভ্যাক্স ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) জানিয়েছে, ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংকটে পড়েছে তারা।
সেরামের প্রধান নির্বাহী আদর পুনেওয়ালা এই ঘাটতির কারণ হিসেবে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের (বিশেষায়িত ব্যাগ ও ফিল্টার ইত্যাদি) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করেছেন।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেল কালচার মিডিয়া, একবার ব্যবহারযোগ্য টিউবিং ও বিশেষায়িত কেমিক্যাল আমদানিতেও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।
কোনো ধরণের সমস্যা ছাড়া ভ্যাকসিন উৎপাদন বজায় রাখতে ও ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আরেকটি ভারতীয় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বায়োলজিক্যাল ই জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। এই প্রতিষ্ঠানটিও ভ্যাকসিন উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বায়োলজিক্যাল ই'র প্রধান নির্বাহী মাহিমা ডাল্টা সম্প্রতি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকরা সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিতে অনিচ্ছুক।
যুক্তরাষ্ট্র বাধা দিচ্ছে কেনো?
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ঘাটতি আছে কিনা তা শনাক্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
বাইডেন এক্ষেত্রে ১৯৫০ সালের ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট (ডিপিএ) আইন ব্যবহার করতে যাচ্ছেন।
এই আইন অনুযায়ী, দেশের জরুরি অবস্থায় দেশীয় পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দেশীয় উৎপাদনে যেসব পণ্যের ঘাটতি তৈরি হতে পারে তা রপ্তানি কমিয়ে আনা সম্ভব এই আইনের মাধ্যমে।
বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে মার্কিন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনে যেসব পণ্য প্রয়োজন তা সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই আইনের ব্যবহার করা হবে।
লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটির ভ্যাকসিন সরবরাহ চেইন বিশেষজ্ঞ ডা. সারাহ শিফলিঙ্গ বলেন, ফার্মাসিউটিক্যাল সাপ্লাই চেইনের বিষয়টি বেশ জটিল।
"এমনকি চাহিদা আকাশ্চুম্বী হলেও নতুন সরবরাহকরা অন্যান্য খাতের মতো দ্রুত উন্নতি করতে পারেন না, অন্তত বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না এতো দ্রুত,"
চলমান বৈশ্বিক ঘাটতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
"কিছু ক্ষেত্রে, হঠাৎ করে যেসব পণ্যের বিশ্বব্যাপী প্রবল চাহিদা তৈরি হয়, তার ঘাটতি তৈরি হবেই,"
ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদনে বাধার প্রভাব
বর্তমানে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড নামে পরিচিত) ও ভারতের তৈরি কোভ্যাক্সিন- এ দুটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন রয়েছে ভারতে।
এবছরের জানুয়ারি থেকে সেরামের উৎপাদিত ১৩ কোটি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে ও ভারতের টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হয়েছে।
বৈশ্বিক সরবরাহ বজায় রাখতে ও দেশীয় চাহিদা পূরণে উৎপাদনও বাড়িয়েছে দেশটির ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো।
গত জানুয়ারিতে সেরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছিল, কোভিশিল্ড ও নোভাভ্যাক্স মিলিয়ে মাসিক ৬-৭ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠানটি।
সেসময় প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে জানায়, মার্চ থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে প্রতি মাসে ১০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে তখনই তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন মজুদ করা হচ্ছে কিনা এবং দেশীয় ব্যবহারের জন্য কত শতাংশ বরাদ্দ রাখা হবে এব্যাপারে কিছু জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি।
দেশীয় ব্যবহারের প্রয়োজন মেটাতে পারছে ভারত?
গত ১৬ জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে ভারত সরকার, এখন পর্যন্ত দেশটির ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। দেশটির বেশ কিছু অংশে আবারও শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাত মাসের মধ্যে ৬০কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে দেশটির সরকার, এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতি মাসে ৮ কোটি ৫০ লাখ ভ্যাকসিন দিতে হবে।
ভারত সরকারের সঙ্গে ১০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহের চুক্তি করেছে সেরাম। ভারত বায়োটেক আরও ১ কোটি ডোজ সরবরাহ করবে।
রাশিয়ার গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও ২০ কোটি ডোজ স্পুটনিক ভ্যাকসিন উৎপাদন লাইসেন্স পেতে চুক্তি করেছে।
এই ভ্যাকসিনগুলোও ভারতে ব্যবহার ও রপ্তানির জন্য ভারতীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবে।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার চুক্তির ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপনের পর রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই এব্যাপ্রটি নিশ্চিত করেছে ভারত সরকার।
কারা ভারতের ভ্যাকসিন পাবে?
নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সে্র সঙ্গেও চুক্তিবদ্ধ সেরাম। গত সেপ্টেম্বরে কোভ্যাক্সে ২০ কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা অথবা নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে সেরাম ইনস্টিটিউট।
জাতিসংঘের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিন সরবরাহের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তিও করেছে সেরাম, এসব চুক্তির আওতায় ৯০ কোটি ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ও ১৪ কোটির বেশি নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
বেশ কিছু দেশে উপহারস্বরূপ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে ভারত সরকার, বিশেষ করে দক্ষিণ এশাইর প্রতিবেশী দেশগুলোতে।
জাতিসংঘের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিন উপহারের দিক দিয়ে চীনের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। দেশটি ৮ কোটি ডোজ বিনামূল্যে পাঠিয়েছে বিভিন্ন দেশে, চীন পাঠিয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ ডোজ।
- সূত্র: বিবিসি