মহামারি নিয়ে ‘ক্ষমার অযোগ্য’ অপরাধ করেছে মোদি সরকার: ল্যানসেট
করোনা সংক্রমণের মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার হুমকি আছে জেনেও প্রস্তুতি নেয়নি মোদি সরকার। উল্টো কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন নেতাদের কর্মকাণ্ডে বাড়ে এর তীব্রতা। আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ নিজ দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণীও অবজ্ঞা করা হয়েছে। এসব কারণেই মোদি সরকারের কঠোর ও প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসিদ্ধ জার্নাল ল্যানসেট। গত শনিবার প্রকাশিত ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে মোদি সরকারের অবহেলা 'ক্ষমার অযোগ্য' বলেও তিরস্কার করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে ভরাবহ কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশটি। আজ রোববার নাগাদ গত ২৪ ঘন্টায় পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে আরও ৪,০৩,৭৩৮ জন। এনিয়ে টানা চারদিন ধরে চার লাখের বেশি কেস রেকর্ড হলো। সব মিলিয়ে আক্রান্ত চিহ্নিত ২ কোটি ২০ লাখেরও বেশি।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন গত শনিবার জানান, ভারতের ৯ লাখ কোভিড রোগীর এখন শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন সহায়তার দরকার হচ্ছে, এটি সক্রিয় সংক্রমণ সংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগ। অন্যদিকে, ভেন্টিলেটর প্রয়োজন ১,৭০,০০০ জনের। দেশটিতে পরীক্ষার বিপরীতে পজিটিভ শনাক্তের হার ২২ শতাংশ বলে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে। এত উচ্চ হারের অর্থ শনাক্তদের চেয়েও বেশি সংখ্যক কোভিড রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছে।
রোববার নাগাদ মারা গেছে ৪,০৯২ জন, এনিয়ে টানা দ্বিতীয় বারের মতো মৃতের সংখ্যা একদিনে ৪ হাজার ছাড়াল।
ভারতে এখন রেকর্ডকৃত মৃতের সংখ্যা ২,৪২,৩৬২- যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের নিজস্ব হিসাব অনুসারে, আগস্ট নাগাদ ভারতে কোভিডে প্রাণহানি ১০ লাখে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।
"এই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে, স্বেচ্ছায় জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টির জন্য সম্পূর্ণরূপে মোদি সরকারই দায়ী থাকবে," বলে ল্যানসেটের সম্পাদকীয় উল্লেখ করে।
বিচার-বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত:
ল্যানসেট সম্পাদকীয় অনুসারে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রথম দিকের সফলতাকে নিজেরাই নষ্ট করেছে ভারত সরকার।
সেখানে বলা হচ্ছে, ভাইরাসের হুমকি দূর হয়েছে, নিজেদের কথাবার্তার মাধ্যমে জনগণকে এমন ভ্রান্ত ধারণা দেন সরকারের শীর্ষ কর্তারা। তাতে করে জনগণ স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনে যেমন উৎসাহিত হয়, ঠিক তেমনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জরুরি পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতিও নিতে পারেনি। কেন্দ্রীয় নীতি-নির্ধারকদের সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে দেশটির টিকাদান কর্মসূচি মাঝপথে এসেও বাধাগ্রস্ত হয় পড়ে। সুপার স্প্রেডার ইভেন্ট বা সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার মতো অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বার বার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও, মোদি সরকার কুম্ভ মেলা আয়োজনের অনুমতি দেয়। একইসঙ্গে, চালাতে থাকে বড় পরিসরের নির্বাচনী র্যালি ও জনসভা।
ল্যানসেটের মতে, সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়। এমনকি, টুইটারকে মোদির সমালোচনা করা বেশ কিছু টুইট সরিয়ে ফেলার নির্দেশও দেওয়া হয়। "সমালোচনা বন্ধের চেষ্টাসহ সঙ্কটের মুহূর্তে মুক্ত আলোচনা না করে, তিনি (মোদি) ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।"
সম্পাদকীয়তে ভারতকে টিকা উৎপাদন ও সমতার ভিত্তিতে বণ্টন নিশ্চিত করার জোর আহবান জানানো হয়। গত শনিবার বিকেল নাগাদ ভারতে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ পায়, অর্থাৎ ১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার মাত্র ২.৭ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে টিকা পেয়েছে।
এছাড়াও, ভারতকে মহামারির স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশ করা, জেনোম টেস্টিং এর পরিধি বিস্তার, জনগণের কাছে মাস্ক পরিধান, জন-সমাগম পরিহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বপ্রণোদিত কোয়ারেন্টিন ও টেস্টিং এর গুরুত্ব তুলে ধরার তাগিদ দেওয়া হয়।
এসব কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব শিথিলতা তুলে ধরে ল্যানসেট জানায়, এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার আগে সরকারের কোভিড-১৯ টাস্কফোর্স কয়েক মাস কোনো বৈঠকেই মিলিত হয়নি।
"এসব সিদ্ধান্তের পরিণতি এখন পরিষ্কার। সঙ্কটমুক্ত হতে হলে ভারতকে অবশ্যই তার ভাইরাস মোকাবিলার প্রতিক্রিয়া সংশোধন করতে হবে। মোদি সরকার নিজেদের আগের ভুলগুলো মেনে নিলেই কেবল সংশোধনের প্রক্রিয়া সফল হবে। বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে স্বাস্থ্যগত পদক্ষেপ গ্রহণে নিশ্চিত করতে হবে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ও তথ্যগত সততা।"
ল্যানসেটের এমন পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কোভিড-১৯ টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান ভি.কে পলের প্রতিক্রিয়া নিতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বার্তা সংস্থা সিএনএন। তবে তিনি এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। ইতঃপূর্বে বিদেশি গণমাধ্যমে মোদি সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনাকে একতরফা মতামত বলে নাকচ করে দেওয়া হয়। তবে ল্যানসেট প্রতিবেদন নিয়ে তারা এখনও মুখ খোলেনি।
- সূত্র: সিএনএন