মিয়ানমারের সামরিক আদালতে গণহত্যার বিচারে দোষী সাব্যস্ত তিন সেনা কর্মকর্তা
মিয়ানমারের একটি সামরিক আদালত সংঘাতপূর্ণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার সঙ্গে দেশটির তিন সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। আজ মঙ্গলবার (৩০ জুন) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে একথা জানানো হয়।
দেশটির সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, 'তিন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাখাইনে গণহত্যায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই অনুসারে সামরিক আদালত তাদের শাস্তি ঘোষণা করেছে।'
কিন্তু, এসব সেনা কর্মকর্তার পরিচয়, তারা কী ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল বা তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তার কোনটাই উল্লেখ করা হয়নি।
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে এই ঘটনার অনুসন্ধান করছে জাতিসংঘের মানবাধিকার আদালত। গণহত্যার তদন্তে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করতে পেরেছে জাতিসংঘ। যার ভিত্তিতে মিয়ানমারকে গণহত্যার দোষীদের বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় আদালতটি।
এরপরই মঙ্গলবার মিয়ানমার সেনা আদালতে গণহত্যার বিচারের কথা জানালো। সামরিক জান্তা প্রভাবিত দেশটির মানবাধিকার রেকর্ড বিবেচনায়, যা অতি-বিরল এক পদক্ষেপ।
তিন বছর আগে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রাক্কালে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান প্রতিবেশী বাংলাদেশে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। এসময়, তারা ব্যাপক গণহত্যা, দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং তাদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মর্মস্পর্শী সব অভিজ্ঞতার কথা জানায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো রাখাইনের একাধিক গ্রামে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে শুধু; গু দার পাইন গ্রামেই পাওয়া গেছে পাঁচটি গণকবর।
প্রথম থেকে গণহত্যায় নিজেদের জড়িত থাকার সকল অভিযোগ অস্বীকার করে আসলেও, জাতিসংঘের চাপের মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সেনা আদালতে বিচারের কার্যক্রম শুরু করে মিয়ানমার। এসময় দেশটির সেনাবাহিনী স্বীকার করে, তাদের কিছু সেনা সদস্য 'রোহিঙ্গা গ্রামে অভিযান চালানোর সময় নির্দেশ অমান্য করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকতে পারে।'
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতে রাখাইনে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষকে সম্ভাব্য সব ধরনের বর্বরতার মধ্য দিয়ে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
২০১৭ সালে আরসা নামের অখ্যাত এক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে নির্মুলের নামে রাখাইন রাজ্যে তথাকথিত 'জঙ্গিবিরোধী' অভিযান চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারের সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব সন্ত্রাস দমনের কথা যেমন বলেছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবেও উল্লেখ করে- সামরিক অভিযানের পক্ষে সাফাই গায়।
তবে গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলার অং সান সুচি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে; সেনা সদস্যদের তরফ থেকে 'অপ্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ' করা হতে পারে বলে স্বীকার করেছিলেন।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অবশ্য চাপের মুখে বলেছে, (অভিযান চলাকালে) বিচ্ছিন্ন কিছু সেনা সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে সুপরিকল্পিত গণহত্যার আলামত পেয়েছেন রাখাইনের মুয়াং নু এবং চুত পাইন গ্রামে।
মঙ্গলবার এই দুই গ্রামে হওয়া অপরাধ সামরিক আদালত তদন্ত করে দেখবে, এমন কথাও জানিয়েছে সেনাপ্রধানের দপ্তরের বিবৃতিটি।
২০১৮ সালে রাখাইনের ইন দিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গা হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয় একটি সামরিক আদালত। কিন্তু মাত্র এক বছরেরও কম সময় কারাবাসের পরই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
অথচ বার্তা সংস্থা এপি'র হয়ে মিয়ানমারের যে দুই সাংবাদিক ওই গণহত্যার সংবাদ বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, তাদের ১৬ মাস বন্দি করে রাখার পর- বৈশ্বিক চাপের মুখে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
রাখাইন রাজ্য এখনও সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং জাতিগত বিদ্বেষের সংঘাতে জ্বলছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
এই অবস্থায় গত রোববারেই জাতিসংঘ চলমান সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, উভয়পক্ষকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে সম্মান জানানোর আহ্বান জানায়। ইতোমধ্যেই বিবাদমান দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, বসতবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন আরও অসংখ্য মানুষ।