মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে শুধু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয়
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় দীর্ঘদিন ধরে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল মিয়ানমার। বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় শুধু বিপর্যস্ত হয় দেশটির নাগরিকরা, পক্ষান্তরে তাতমাদাউ' বা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ বিন্দুমাত্র শিথিল হয়নি। এক দশক আগে যখন তারা গণতন্ত্র চর্চার জন্য কিছুটা ছাড় দিয়েছিল- সেটাও দেয় নিজেদের মর্জি-মাফিক শর্তের আওতায়। গেল ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানে প্রমাণিত হয় তারা চাইলেই সেটা আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে পারে চোখের পলকে।
বহিঃবিশ্বের শক্তিগুলো আর্থিকখাতে কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের লাগাম টেনে ধরতে যে কতখানি ব্যর্থ- নতুন করে তার উদাহরণ দিচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দরিদ্র্যতম জাতিটি। নিষেধাজ্ঞার কারণে নিজ জনগণের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে ওঠা নিয়ে স্বৈরশাসকদের দুর্ভাবনা যে নেই তা সহজেই বোধগম্য। যেমন নেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অপমানিত হওয়া নিয়ে মাথাব্যথা।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীও সেদিকে ইঙ্গিত দেয়- এইতো গেল সপ্তাহান্তে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে বর্মী সেনা জান্তা আয়োজন করে বিশাল ভোজের, প্রদর্শন করে অত্যাধুনিক ড্রোন বহর। অথচ সেদিন কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে সেনাবাহিনী, এমনকি একজনকে পুড়িয়েও মারা হয়।
বেসামরিক নাগরিকদের উপর নিষ্ঠুরতা চলাকালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিস্ক্রিয় থাকার কোনো যুক্তি বা অজুহাত থাকতে পারে না। বিশেষ করে, যখন প্রতিনিয়ত দমনের মাত্রা নিষ্ঠুরতর হচ্ছে, যার হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও পালাচ্ছে মানুষ। এই অবস্থায় ইতোপূর্বে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র বিরতি পালন করা জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ফিরছে।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীগুলোর সংগঠিত পৈশাচিকতায় এপর্যন্ত ৫ বছর বয়সী শিশুসহ অন্তত ৫০০ জনের প্রাণহানির কথা জানা গেছে। অনেককেই হত্যা করা হয়েছে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিৎ এমন উচ্চ- সক্ষমতার রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়ে। কাউকে কাউকে আবার তাদের বাসস্থানে অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটি চলমান একটি মানবিক বিপর্যয়, যা অচিরেই বড় আকারের শরণার্থী সংকটে রূপ নিতে পারে। উড়িয়ে দেওয়া যায় না গৃহযুদ্ধ বা পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রক্সি-যুদ্ধের সম্ভাব্যতা। এসব ঘটনার মিশ্রিত পরিণতির সৃষ্টি হবে না- তাই বা কে বলতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা এমন বিপর্যয় মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্যই একে প্রতিরোধ করতে হবে।
তবে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে প্রকৃত পরিস্থিতির বাস্তবভিত্তিক পর্যালোচনা যেমন দরকার, তেমনি দরকার তার ভিত্তিতে অর্জন করা সম্ভব এমন লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ। সেনা জান্তার বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে কোনটি জরুরী এবং কেমনতর সমঝোতার মাধ্যমে দেশটিকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা যায়- তা অনুমানে ভুল করা যাবে না।
পশ্চিমা বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিক্ষোভ দমনে জান্তা সরকারের আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্যেও যে সঙ্কট তাদের সীমান্তের দিকে ধেয়ে এসেছে, তাকে অবহেলা করা যথাযথ হবে না। মিয়ানমারের সেনা শাসকসহ অভিজাত শ্রেণির উপর ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে তাদেরকেও। চীন এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে বেইজিং এমন পদক্ষেপ নিলে- নিশ্চিতভাবেই কোণঠাসা হবে জান্তা প্রশাসন।
এর বিপরীতে মানবিক সহায়তা এবং ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে মিয়ানমারের জনগণের প্রতি সরাসরি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব। সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তাদের মধ্যে জনতার দাবির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করে তাদের দলত্যাগী করে তোলা গেলে, শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন দেখা দেবে। শুধু শুধু নিন্দামূলক বিবৃতি দেওয়ার চাইতে- এতে বরং ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে; মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া সেনা কর্মকর্তা ও তাদের অধীন ইউনিটগুলোই ক্যু'র পর সবচেয়ে বেশি নির্মমতা চালিয়েছে। জান্তা নিয়ন্ত্রিত সকল মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপরও বহাল হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। ইউরোপও একই রকমের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেয়।
পদক্ষেপগুলো কঠোর অবস্থানের বার্তা দিলেও- মনে রাখা উচিৎ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বহিঃশক্তির প্রভাব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, একারণে নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত প্রভাব ছিল সীমিত। মহামারির কারণে অভ্যুত্থানের আগেই দুরাবস্থায় পড়েছিল দেশটির রাজস্ব আয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর আছে মাদক চোরাচালানসহ নানা রকম অবৈধ বাণিজ্যের গোপন আয়ের নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক সহজে যেমন শনাক্ত করা যায় না, তেমনি সহজেই নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল এড়াতে পারে। অতীতের সেনা শাসকেরা এভাবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুটতরাজ করেছে।
দুঃশাসনের কারণেই বিপুল সম্পদ থাকার পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার সঙ্কট ছিল মিয়ানমারে। এক দশক আগে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হওয়ার সুবাদে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো সে ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসে। টেলিকম, ব্যাংকিং ও পোশাক শিল্প গঠনে বড় বিনিয়োগ করে তারা। কিন্তু, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের পর মিয়ানমার আকর্ষণীয় বাজারের অবস্থান হারাতে থাকে। মিয়ানমারের জান্তা ভেবেছিল, অভ্যুত্থানের পরও অর্থনীতি অপরিবর্তিত থাকবে। দেশটির তৃণমূল পর্যায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ব্র্যান্ডগুলো পরিত্যাগের মাধ্যমে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের সেই আশাপূর্ণ হওয়ার নয়।
অর্থাৎ, স্থানীয় জনগণের মাধ্যমেই কার্যকর একটি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। সেই তুলনায় দুর্বল আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে,যুক্তরাজ্যের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক গবেষক লি জোন্স জানান, ১৯৮৮ সালের জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের কালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বর্মী সেনাবাহিনী পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলার মতো ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে। অন্যান্য দেশের সেনা জান্তার মধ্যে গোষ্ঠীগত বিরোধ থাকলেও, মিয়ানমারের জান্তা সেই তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল।
তবে স্থানীয় বয়কটের মতোই কার্যকর হতে পারে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের বয়কট। জান্তা বিরোধী বিক্ষোভের কালে চীন নিয়ন্ত্রিত অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়েছে। জান্তা যে চীনের একান্ত অনুগামী নয় এর মাধ্যমে সেটাও স্পষ্ট হয়। চীনের তাই নিরুদ্বেগ বসে থাকা উচিৎ নয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানকেও এখনই তৎপর হতে হবে। মিয়ানমারের জান্তার প্রতি ব্যবসা-বাণিজ্য ও দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগে তারা যেন সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে- তা নিশ্চিত করার জন্য কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকেই।
- লেখক: পণ্যবাজার, পরিবেশ, সামাজিক ইস্যু ও সরকারি নীতি নিয়ে ব্লুমবার্গে মতামত কলাম লেখেন ক্লারা ফেরেইরা মার্কুইজ। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজ শাখায় সহ-সম্পাদকের পদে ছিলেন। সংস্থাটির সম্পাদক ও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন; সিঙ্গাপুর, ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়াতে।