যেখানে নেই হাসপাতাল ও চিকিৎসক, ভারতের সেই গাঁওগঞ্জেই এবার কোভিডের তাণ্ডব
ভারতের এক ছোট্ট গ্রাম চৌগাঠ। কোভিড অনুপ্রবেশ করেছে নিভৃত এই পল্লীতেও। এই অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো অপ্রতুল, তাই স্থানীয় ফার্মেসিস্ট জিতুই হয়ে উঠেছেন মানুষের শেষ ভরসার স্থল।
আঞ্চলিক কেন্দ্র বলে পরিচিত নগর আর বড় বড় মহানগরকে আগেই কব্জা করেছে কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। হাসপাতালে অক্সিজেন আর ওষুধ সঙ্কটের ঘটনা এখন নতুন স্বাভাবিকতা যেন।
কিন্তু, শহরাঞ্চলে অন্তত আছে সরকারি- বেসরকারি চিকিৎসা অবকাঠামো । যার বিপরীতে দূর-দূরান্তের প্রদেশগুলোর গাঁওগঞ্জে না আছে চিকিৎসক, না আছে বেসরকারি ক্লিনিকের রমরমা উপস্থিতি। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র কদাচিৎ যা চোখে পড়ে, তা কোভিড চিকিৎসার উপযুক্ত নয়। ফলে ওষুধ ও সঠিক পরিচর্যার অভাবকে সঙ্গী করেই কোভিডের বিরুদ্ধে নিভৃত এক লড়াই চলছে গ্রামীণ জনপদে।
ভারতীয় পল্লী অঞ্চলে কোভিড দুর্দশার ছোট্ট ক্যানভাস যেন পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যের চৌগাঠ গ্রাম। ২০১১ সালের জরিপ অনুসারে, গ্রামের বাসিন্দার সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার। অথচ তাদেরই অন্তত পাঁচ থেকে ছয়শ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন বলে চলতি সপ্তাহের শুরুতেই সিএনএনকে জানান স্থানীয় ফার্মাসিস্ট জিতু। মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির কথাও জানান গ্রামের অন্যরা।
গ্রামটিতে একজনও চিকিৎসক বা জরুরি স্বাস্থ্য কর্মী (মেডিক) নেই। সবচেয়ে কাছের মফস্বলে যেতেও লাগে এক ঘণ্টা। তাছাড়া, আশেপাশের গঞ্জ এলাকায় কিছু ক্লিনিক থাকলেও ,এসব ছোটখাট স্থাপনায় শয্যাগুলো পূর্ণ হয়েছে ইতোমধ্যেই, রয়েছে প্রাণদায়ী চিকিৎসা উপকরণের ঘাটতি। তাই সেখানে গ্রাম থেকে আসা রোগীর চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগও কম।
এই অবস্থায় চৌগাঠে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে, স্থানীয়ভাবে জিতু ভাই বলে পরিচিত ব্যক্তিটিই নিজের কাঁধে জরুরি চিকিৎসা কর্মীর ভার তুলে নেন। ফার্মেসিস্ট হিসেবে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি অক্সিজেন যোগাড় করে দেওয়াসহ ওষুধপত্র বাৎলে দেওয়াও শুরু করেন।
"কেউ নেই এখানে- স্বাস্থ্য কেন্দ্র, চিকিৎসক, নার্স- কেউ নেই। আমাদের গ্রামে কোনো চিকিৎসা অবকাঠামো না থাকায় নিরুপায় হয়ে আমি নিজে যেমনটা ভালো বুঝছি, তেমন করেই চিকিৎসা দিচ্ছি।"
সাহায্য পেতে দুর-দূরান্তে ছুটে চলা:
রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে শুরু করে ভারতের প্রতিটি কোণায় থাবা বসিয়েছে ঘাতক কোভিড-১৯। সংক্রমণের প্রথম ঢেউ থেকে মফস্বলগুলোও ছিল অনেকটা সুরক্ষিত, কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামীণ জনপদেও বাসা বেঁধেছে।
ভাইরাসের এই সাম্প্রতিক বিস্তারে গত এক মাসে প্রতিদিন লাখ লাখ জনকে আক্রান্ত করে। সরকারি হিসেবেও দৈনিক মৃত্যু হচ্ছে কয়েক হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে, মহামারি শুরুর পর এপর্যন্ত ২ কোটি ৩০ লাখ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কোভিড প্রভাবিত দেশ হয়ে উঠেছে ভারত।
হাতের কাছে দরকারি চিকিৎসা সহায়তা না থাকায় চৌগাঠের মতো গ্রামের বাসিন্দাদের আশেপাশের মফস্বল শহরে হাসপাতালের শয্যার খোঁজে বিপন্ন রোগী নিয়ে ছুটতে হচ্ছে।
চৌগাঠের এক বাসিন্দা দীনেশ মাকওয়ানা জানান, তিনি কোভিড পজিটিভ শনাক্ত বাবাকে নিয়ে আশেপাশের চারটি শহর ঘুরেও হাসপাতালে ফাঁকা শয্যা পাননি। বাধ্য হয়েই গুরুতর সংক্রমণ থাকা সত্ত্বেও, বাবাকে গ্রামে ফিরিয়ে আনেন।
"মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গ আমাদের বিস্মিত করেছে, পুরো গ্রামের মানুষই পরিস্থিতির ভয়াবহতায় চমকে গেছে। সকলের মনেই এখন ভয় কাজ করে," দীনেশ বলেন।
"গ্রামের অনেকেই কোভিডে প্রাণ হারিয়েছেন, তাই আমার বাবাও মারা যাবেন বলে আমি ভয় পেয়েছিলাম।।"
গ্রামের সবার কাছে জিতু ভাই বলে পরিচিত সেই ফার্মেসিস্টই অবশেষে দীনেশের বাবার জন্য কিছু জরুরি ওষুধের ব্যবস্থা করে দেন, এতে তার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু, পরিবারটির দুর্ভোগ তারপরও শেষ হয়নি, এখন দীনেশের মা ও বোনও সংক্রমিত হয়েছেন।
দীনেশ সিএনএন'কে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়, তার মা বাড়ির বারান্দায় শয্যাশায়ী ছিলেন, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার।
দীনেশের বাবা জিভরাজ বলেন, "পরিবার নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমি মরে গেলে আমার পরিবারও ভেঙ্গে পড়বে। নিজের স্ত্রীকে নিয়েও চিন্তা করি, কিন্তু মৃত্যু ভয় আমাকে কাবু করতে পারেনি।"
"এখানে কেউ আসতে চায় না"
চৌগাঠের ৭০ বছরের বাসিন্দা গিরিজাশঙ্কর শ্মশানের দাহকাজে সাহায্য করছেন। প্রতিদিন একাধিক মৃত্যু এখন নিয়মিত ঘটনা, তাই নতুন চিতা প্রস্তুত করতে প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা থেকে ট্রাক্টর ভরে কাঠ নিয়ে আসেন তিনি।
গিরিজাশঙ্কর জানান, মহামারির আগে প্রতিবছর নানা কারণে গ্রামে কমবেশি ৩০ জন মারা যেত, কিন্তু গত এক মাসেই শ্মশানে ৯০টির বেশি শব এসেছে। ভাইরাসের কবলে কিছু পরিবার একাধিক সদস্য হারিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ভারতের কিছু বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কমিটির সদস্যরা ইঙ্গিত দেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানো শুর করেছে, অর্থাৎ তারপরেই দেখা যাবে দৈনিক কেস সংখ্যা কমার সম্ভাবনা। কিন্তু, দৈনিক সংক্রমণ কমার অনেক পরও মৃত্যু সংখ্যা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়, এমনটা হলে চলতি মাস জুড়েই অব্যাহত থাকবে প্রাণহানির ঊর্ধ্বমুখী মিছিল।
সমালোচনার মুখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রতিক্রিয়া জোরদার করেছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। গত এপ্রিলের শেষ দিকে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো থেকে পাওয়া ত্রাণ এখন নানা রাজ্যে বণ্টন শুরু হয়েছে।
কিন্তু, সরকারি সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বেশিরভাগ অক্সিজেন ও ওষুধ সরবরাহ পাচ্ছে জনবহুল শহরগুলো। ফলে চৌগাঠের মতো ভারতের অধিকাংশ গ্রাম এখন অসহায়, ভাইরাস একের পর এক পরিবারকে আক্রান্ত করলেও, তাদের অধিবাসীরা নিরুপায়।
"গ্রামে সরকারি ত্রাণ নেই, চিকিৎসক নেই। বড় হাসপাতালে যাওয়ার উপায় নেই আমাদের। দুর্যোগের এই সময়ে কেই গ্রামে আসতে চায় না, সরকারের কোনো কর্মী এখানে আসেননি," গিরিজাশঙ্করের কণ্ঠে আক্ষেপ ফুটে ওঠে।
জিতু নামের সেই ফার্মেসিস্ট জানান, স্বাস্থ্য সেবা এবং কর্তৃপক্ষের সহায়তার অভাব নিয়ে তিনি শুরু থেকেই অসন্তুষ্ট। "আমি একা কী করতে পারি। আমাদের কোনো সমাধান দেওয়া হয়নি, এখানকার মানুষও হতদরিদ্র।"
সব কিছু মিলিয়ে গ্রামবাসীর রোগমুক্তির প্রার্থণা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
দীনেশ বলেন, "গ্রামের মানুষ ভয় পাচ্ছেন, আর সেটাই স্বাভাবিক। গত ১৫-২০ দিনে এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে, যে কেউ ঘরের বাইরে বেরোতে চাইছে না। সংক্রমণের আতঙ্ক সকলের মনের গহীনে।"
- সূত্র: সিএনএন