রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি ছায়া সরকারের, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, ন্যায়বিচার ও নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সামরিক জান্তা উৎখাতের লড়াইয়ে নিপীড়িত এই সংখ্যালঘুদের যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী ছায়া সরকার।
মিয়ানমারে কয়েক দশক ধরে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারের আন্দোলনে বিবৃতিটিকে 'একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ' বলে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।
কয়েক শতক ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অবস্থান করলেও সেখানে তাদের বহিরাগত হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিসহ (এনএলডি) বিভিন্ন সরকারের আমলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সু চির সরকার 'রোহিঙ্গা' শব্দের ব্যবহারই বাতিল করে। পরিবর্তে, সংখ্যালঘু এই জাতিগোষ্ঠীকে 'রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
রোহিঙ্গাদের জেনোসাইডের দায়ে অভিযুক্ত সামরিক জান্তাকে রক্ষায় ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগে ভ্রমণ করেন সু চি। শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চির এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের হতবাক করেছিল।
বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) প্রদত্ত বিবৃতিতে মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। জান্তাবিরোধী এই ছায়া সরকারের সাথে যুক্ত আছেন সু চির এনএলডির বহু রাজনীতিক।
বিবৃতিতে বলা হয়, "সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা এবং সহিংসতার অভিজ্ঞতা লাভের পর বার্মার সকল মানুষই এখন রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল।"
এছাড়া সেখানে আরও বলা হয় যে, "বর্তমানে পুরো জনগোষ্ঠীর সংহতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। আমরা এমন একটি জোট গঠনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যেখানে দেশের ভবিষ্যতের সাথে জড়িত সকল মানুষের আকাঙ্খা পূরণ করা হবে।"
এছাড়া, জাতীয় ঐক্য সরকার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল করবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করে এই আইন বাস্তবিক অর্থেই রোহিঙ্গাদের বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।
এনইউজি বলেছে, মিয়ানমারে জন্মগ্রহণের ভিত্তিতে বা যেকোনো স্থানে মিয়ানমারের নাগরিকদের সন্তানদের নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে দেশটির নাগরিক নির্ধারণ করা হবে।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এনইউজি গঠিত হয়। সামরিক সহিংসতার কারণে পালিয়ে যেতে বাধ্য রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতিও প্রদান করে এনইউজি।
এছাড়া, "রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংগঠিত সকল অপরাধের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা সক্রিয়ভাবে দাবী করা হবে" বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছে। শরণার্থী শিবিরে জনাকীর্ণ পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই রোহিঙ্গারা।
এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ শরণার্থী সামরিক বাহিনীর অভিযানে সহিংসতা, ধর্ষণ, গণহত্যা এবং বাড়িঘর হারানোর পর বাধ্য হয়ে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
এনইউজি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাইছে। কিন্তু, পরিবর্তে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকৃতি প্রদান এবং অধিকার রক্ষার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
যুক্তরাজ্যের বার্মিজ রোহিঙ্গা অরগানাইজেশনের সভাপতি তুন খিন এনইউজির এই বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে, এনইউজি কীভাবে আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বিচার দাবী করবে এই বিষয়টিসহ অন্যান্য বিষয়ে আরও স্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
'রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড পরিচালনার বিষয়টি কতটুকু গুরুতর তা অবশ্যই এনইউজিকে স্বীকার করতে হবে," বলেন তিনি।
খিন আরও বলেন, "আমরা যদি অতীতের বাস্তবতার সম্মুখীন না হই, তাহলে আমরা কখনোই মিলিত ভবিষ্যৎ গড়তে পারব না।"
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুজ এনইউজির এই বিবৃতিকে 'একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ' হিসেবে উল্লেখ করেন।
এক বিবৃতিতে তিনি জানান, "রোহিঙ্গাদের জন্য শান্তি, ন্যায়বিচার এবং নিরাপত্তার দাবী দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকৃত হলেও আমি আশাবাদী যে, আজকের এই নীতিমালা বিষয়ক বিবৃতি দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ চিহ্নিত করেছে।"
এছাড়া, মিয়ানমারের বৈধ সরকার যেন এই প্রতিশ্রুতিকে আইনে রূপান্তর করতে পারে, সেজন্য সামরিক জান্তার প্রতি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রয়োগকৃত চাপ বাড়াতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গত পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৪৫ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া, নির্বাচিত রাজনীতিকসহ বন্দি আছে আরও হাজারো মানুষ।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান