সুয়েজ খাল অচলের জন্য মিশরের প্রথম নারী ক্যাপ্টেনকে দোষারোপ!
সুয়েজ কাণ্ডে বিশ্বজুড়ে কম হইচই হয়নি। গত মাসের ২৩ তারিখ সকালে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথে ঝড়ো বাতাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরে যাওয়ায় আড়াআড়িভাবে সুয়েজ খালে আটকে পড়ে 'এমভি এভার গিভেন' নামের একটি মালবাহী জাহাজ। জাহাজটির অবস্থানের কারণে বন্ধ হয়ে যায় সুয়েজ খাল; ভূমধ্যসাগর থেকে খালের উত্তরে এবং লোহিত সাগর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৩৬০ টি জাহাজের যাতায়াত স্থবির হয়ে পরে। উভয়প্রান্তে আটকা পড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
এই খবরের পাশাপাশি মিশরের প্রথম নারী ক্যাপ্টেন মারওয়া ইলেসেলহদার (২৯) চমকে যান আরেকটি সংবাদে। অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন 'গুজব' থেকে তিনি বুঝতে পারেন, সুয়েজ খালের এই অচলাবস্থার জন্য তাকে দায়ী করা হচ্ছে!
মারওয়ার ভাষায়, 'আমি রীতিমত অবাক হয়ে যাই'।
সুয়েজ অবরুদ্ধের সময়টাতে মারওয়া ছিলেন কয়েকশত মাইল দূরে আলেকজান্দ্রিয়ায়, সেখানে আইদা দ্য ফোর্থ জাহাজের ফার্স্ট মেট হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
আরব নিউজ থেকে প্রকাশিত তাকে নিয়ে একটি সংবাদের ভুয়া শিরোনাম স্ক্রিনশট আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে মারওয়া ইলেসেলহদারের বিরুদ্ধে সুয়েজ খালের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
সে খবরে প্রকাশিত একটি বানানো ছবি নেয়া হয়েছে আরব নিউজে ২২শে মার্চ প্রকাশিত একটি আসল খবর থেকে; সে ছবিটি টুইটার এবং ফেসবুকে কয়েক শত বার শেয়ার করা হয়েছে। অথচ ২২ মার্চ প্রকাশিত সংবাদে মিশরের নৌবাহিনীতে যোগ দেয়া প্রথম নারী ক্যাপ্টেন হিসেবে মারওয়ার সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা হয়।
এর পাশাপাশি মারওয়ার নামে খোলা বেশ কিছু টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এভার গিভেনের আটকে পড়ার সাথে তার সম্পৃক্ততার মিথ্যা দাবি করা হয়েছে।
কে বা কারা এই খবর ছড়াল, আর এর পেছনে তাদের কী স্বার্থ কাজ করেছে সে নিয়ে বিবিসির কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মারওয়া নিজেই।
তিনি বলেন, "নৌবাহিনীর একজন সফল নারী কর্মকর্তা হওয়ার কারণে হয়ত আমাকে এই ভুয়া সংবাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হতে পারে। কিংবা কে জানে মিশরীয় হিসেবে আমার জাতিগত পরিচয় হয়তো এখানে ভূমিকা রেখে থাকবে"।
পুরুষশাসিত শিল্পক্ষেত্রে তিনিই প্রথম নারী কর্মকর্তা নন, যিনি এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এর তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ২% নারী সমুদ্রপেশায় নিয়োজিত।
মারওয়া জানান, সমুদ্রের প্রতি টান তার সবসময় ছিল এবং তার ভাইকে দেখে তিনিও নৌবাহিনীতে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত হন।
সেসময় মিশরের নৌবাহিনীতে কেবল পুরুষদেরই কর্মের সুযোগ ছিল। তবু মারওয়া থেমে থাকেননি, তিনি ঠিকই আবেদন করেন এবং মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারক কর্তৃক একটি আইনি পর্যালোচনা শেষে যোগদানের অনুমতি লাভ করেন।
একাডেমিতে থাকাকালীন প্রতিটি মুহূর্তে তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মারওয়া।
তিনি বলেন, "মেয়েরা দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে, পরিবার থেকে দূরে সাগরের বুকে কাজ করবে, এটা এখনও আমাদের সমাজ গ্রহণ করতে শেখে নি"।
"কিন্তু আপনি যখন নিজের ভালবাসার কাজটি করে যাবেন, তখন আপনার অন্য কারও কাছ থেকে সম্মতির প্রয়োজন পড়বে না"।
২০১৭ সালে নারী দিবসের আয়োজনে তাকে সম্মান জ্ঞাপন করেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি।
সুয়েজ খালের ঘটনায় যখন তার জড়িত থাকার গুজব ছড়াল, তখন নিজের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে মারওয়া শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ।
বিবিসিকে তিনি বলেন, "এই ভুয়া সংবাদটি ইংরেজি ভাষায় লেখা ছিল। ফলে মিশরের বাইরেও অন্যান্য দেশে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে"।
"সংবাদ নিবন্ধটি আমার এতদিনের অর্জন এবং সম্মানের ওপর প্রভাব ফেলছিল। ফলে আমি সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করি"।
তিনি বলেন, "অনলাইনে সংবাদের নিচে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য এসে জমছিল। তবু অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন এবং আমার ও আমার কাজের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন"।
যেসব নারী সমুদ্রযাত্রায় অংশ নিয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উদ্দেশ্যে মারওয়া ইলেসেলহদার বলেন, "নিজে যা করতে ভালবাসেন তার বাস্তবায়নে লড়াই চালিয়ে যান। কোন নেতিবাচক কিছুকে আপনার ওপর প্রভাব ফেলতে দেবেন না"।
উল্লেখ্য, প্রায় এক সপ্তাহ পর ২৯ শে মার্চ সুয়েজে আটকে থাকা জাহাজটি আংশিকভাবে অবমুক্ত হয়। গতকাল থেকে জাহাজ জট পুরোপুরি সরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যিক নৌপথে চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে ।
- বিবিসি অবলম্বনে