সেনা অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারে ব্যাপক ধরপাকড়ের আশঙ্কা
মাত্র একদিন আগেই সামরিক জান্তার হাতে অং সান সু চি ও অন্যান্য নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ আটক হওয়ার পর মিয়ানমারে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। আজ মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুনে ছিল অন্য দিনের চাইতে অস্বাভাবিক নীরবতা।
সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে দেশের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কিত দেশটির নাগরিকরা। ৫০ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা থাকাকালের ভয়াল স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে জনসাধারনের মনে। সেসময় সমালোচক, সাংবাদিক, শিল্পী, কর্মীসহ অসংখ্য মানুষকে সেসময় প্রতিনিয়ত কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের উপর পরিচালিত হয় বর্বর, অমানুষিক নির্যাতন।
সোমবারের সেনা অভ্যুত্থান তাই আবারও সেই অতীত অন্ধকারে সময়ের প্রারম্ভ কিনা- তা নিয়ে প্রতি মুহূর্ত ভয় ও উদ্বেগে কাটাচ্ছে জনগণ। নির্বাচনে জালিয়াতির দায়ে সব মিলিয়ে ২৪ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে সামরিক জান্তা এবং তাদের পদে নিজেদের ১১ জন সদস্যকে বসিয়েছে।
আটকের পর সু চি সহ ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি(এনএলডি) এর আটককৃত অন্য নেতারা কে কোথায় আছেন- তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, বেশিরভাগ নেতাই রাজধানী নেপিডোতে নিজ নিজ বাসভবন থেকে আটক হয়েছেন।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এনএলডি তাদের প্রেসিডেন্ট মিন্ট ও সু চি সহ অন্যসব নেতাকর্মীর তাৎক্ষণিক মুক্তি দাবি করেছে।
তারা এই অভ্যুত্থানকে মিয়ানমারের ইতিহাসের এক 'জঘন্য ঘটনা' বলে আখ্যা দিয়েছে।
নেপিডোতে মঙ্গলবার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খুললেও কড়া নিরাপত্তা বজায় রয়েছে। সংসদের গেটে ভারি ট্যাংক ও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পার্লামেন্ট ভবনে গ্রেপ্তারকৃত কিছু আইনপ্রনেতাকে রাখা হয়েছে বলেও জানা যায়।
এছাড়াও, দেশজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সচল রয়েছে, যদিও ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগে কিছু বাধা দেখা গিয়েছে।
এনএলডি মুখপাত্র চি তোয়ে সোমবার তার ফেসবুক পেজে করা এক পোস্টে জানান, সু চি তার নিজ বাসভবনেই আটক আছেন ও সুস্থ আছেন।
দলের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে সু চির পক্ষ থেকে এই সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনগনকে প্রতিবাদ করার আহবান জানান হয়। যদিও এই বিবৃতির সত্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিবৃতির নিচে সু চির নাম থাকলেও তার সই ছিল না। তাছাড়া আটক অবস্থায় তিনি কি করে বিবৃতি দিলেন তাও স্পষ্ট নয়।
বিশ্লেষকরা সন্দেহ করছেন, দলের ও সু চির অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট হয়তো হ্যাক করে এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে মানুষকে এমন পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে, যা হয়তো সামরিক জান্তাকে আরো শক্তি প্রয়োগের সুযোগ করে দিবে।
যদিও সু চির সমর্থকরা এখনো রাস্তায় নামেনি, কিন্তু ইয়াঙ্গুনে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী জনরায়ের অবমাননা করেছে।
তবে অনেকে এই প্রশ্নও তুলেছেন যে, সামরিক জান্তা যেখানে সু চির দল ও তার সাথে সমঝোতায় এসেছিল এবং এতে তাদের লাভই হচ্ছিলো, তা সত্ত্বেও কেন তারা সেনা অভ্যুত্থান করলো। মিয়ানমারে সংসদের ২৫% আসন সেনাদের জন্য সংরক্ষিত এবং বিভিন্ন ক্ষমতাশালী মন্ত্রণালয়ের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
ইয়াঙ্গুনের এক সাংবাদিক জানান, যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে তিনি সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। তার ধারণা সাংবাদিকরা হবে সেনাদের পরবর্তী টার্গেট। এই সাংবাদিকের কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে, "এখন মিয়ানমারের সবাই বুঝে গেছে যে আসল ক্ষমতা কার হাতে আর সামরিক জান্তা কী করতে পারে। গত পাঁচ বছর আমরা নামেমাত্র যে স্বাধীনতা পেয়েছি তা আসলে কিছুই না।"
স্বৈরশাসক জেনারেল নে উইন এর অপশাসনের ফলে গোটা মিয়ানমার দারিদ্রের ছায়ায় ঢেকে গিয়েছিল এবং ১৯৮৮ সালে তার বিরুদ্ধে হওয়া এক গণজোয়ারকেও সামরিক বাহিনী কঠোর হস্তে দমন করে। সে বছর আরেকটি আইন জারি করে হাজার হাজার মুক্তিকামী রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেকেই তখন পালিয়ে নির্বাসনে চলে যান কিংবা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গঠিত সংগঠন এবিএসডিএফ- এ যোগ দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাংবাদিক বলেন, "এই ৩৫ বছর ধরে শুধু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, আমাদের জীবনে নতুন কিছু নেই। সেই সময়ের বিভীষিকা এখনো আমাদের মনে রয়ে গেছে। নিজ দেশ ছেড়ে পালাতে কিংবা বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী থাকতে কেউই চায় না।"
মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের এই ঘটনাকে 'গণতন্ত্রের উপর মারাত্মক হামলা' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূত টম অ্যান্ড্রুজ সোমবার মিয়ানমারে সেনা মোতায়েন নিয়ে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে নিরাপত্তা পরিষদকে অনুমোদন দেওয়ার আর্জি জানান।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি সদ্য দায়িত্ব নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনেও একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বাইডেন মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের পদত্যাগ করতে বলে এবং ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সেনা অভ্যুত্থান পরবর্তী সামনের দিনগুলোয় কি হবে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে।
মঙ্গলবার জাপানের সুজুকি মোটর কর্পোরেশন জানিয়েছে, সেনা অভ্যুত্থানের পর কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারে তাদের দুটি ফ্যাক্টরি বন্ধ রেখেছে। সেখানে ৪০০ লোক কাজ করে এবং প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মিতসুরু মিজুতানি জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তারা পুনরায় কারখানা খুলবেন না।
- সূত্র: সিএনএন