‘এটা যুদ্ধাবস্থার মতো’: অক্সিজেনের জন্য দিল্লির হাসপাতালে হাহাকার
দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মুলচান্দ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ডাক্তার আলী রেজা। রোগীতে পরিপূর্ণ জরুরি বিভাগে দম ফেলার সুযোগ নেই। অক্সিজেনের পরবর্তী সরবরাহ কখন এসে পৌঁছাবে সেই হিসাবও রাখছেন না ডাক্তার রেজা। ইতোমধ্যে তার অধীনে কাজ করা ২০ জন ডাক্তারের ১২ জনই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ওদিকে থেমে নেই হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা নতুন রোগীদের ঢল।
"এপ্রিল ও মে মাসে দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে আমরা ধারণা করেছিলাম। তবে তা এত দ্রুততম সময়ে আর ভয়ানকভাবে ধাক্কা দিবে, সেটা আমরা কখনো ভাবিনি। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে এখানে সবাই আসে। সবারই অক্সিজেনের প্রয়োজন," বলেন তিনি।
ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গঙ্গাদ্বীপ ত্রিহান মাত্রই জানতে পারেন যে হাসপাতালটিতে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। অক্সিজেন নিয়েও আছে সংকট। বাইরে গাড়িতে নিঃশ্বাসের জন্য ছটফট করছেন গঙ্গাদ্বীপের চাচা। চারটি অক্সিজেন ট্যাংক নিয়ে পাঞ্জাব থেকে ৩১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রোগীকে নিয়ে দিল্লিতে আসেন তিনি। ছয়টি হাসপাতাল ইতোমধ্যে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। সাত নাম্বার হাসপাতালের অনুসন্ধানে গাড়ির দিকে পা বাড়ান গঙ্গা।
"আমি ভয় পাচ্ছি যে চিকিৎসা না হলে উনাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আমি হাসপাতাল শয্যার জন্য যেকোনো মূল্য দিতে রাজি আছি," বলেন তিনি।
দিল্লির হাসপাতালের ভেতরকার এই দৃশ্য থেকে ভারতজুড়ে বিদ্যমান অস্থিরতার ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্বে সবথেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই করোনার এই নতুন ধরন বা ভ্যারিয়্যান্ট মানুষের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা এমনকি টিকাদান কার্যক্রমকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিয়েছে নতুন এই ঢেউ। মঙ্গলবার, ভারতে নতুন করে তিন লাখ ২৩ হাজার করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর এক কোটি ৭৬ লাখ সংক্রমণ সংখ্যা নিয়ে বর্তমানে বিশ্বে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়।
এক কোটি ৬০ লাখের অধিক মানুষের শহর দিল্লিতে মঙ্গলবার সকালে মাত্র ১২টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। শয্যা ছাড়াও অক্সিজেন, রেমডিসিভির এবং অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলে হাহাকার।
'প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ি'
কোভিড রোগীদের বিশেষায়িত সেবাদানকেন্দ্রের মধ্যে দিল্লির এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট বেসরকারি মুলচান্দ হাসপাতাল অন্যতম প্রধান। সপ্তাহের শেষ নাগাদ হাসপাতালটির পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। নিরুপায় হয়ে অক্সিজেনের জন্য টুইটারের শরণাপন্ন হয় মুলচান্দ হাসপাতাল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দিল্লি সরকারের শীর্ষস্থানীয়দের ট্যাগ করে হাসপাতালটি অক্সিজেন সংকট নিয়ে সতর্কবার্তার জানান দেয়। দুই ঘন্টার ভেতর অক্সিজেন সরবরাহ শেষ হয়ে গেলে লাইফ সাপোর্টে থাকা বিশাল সংখ্যক মানুষকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রাত দুটোর সময় হাসপাতাল কর্মীর কাছ থেকে অক্সিজেন সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার সংবাদ শুনে এই সতর্কবার্তা প্রচার করেন মুলচান্দ হেলথকেয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিভু তালওয়ার।
"সকাল সাতটা বেজে গেলে আমাদের হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় ছিল। আর তাই আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়টুকু আমাদের ব্যবস্থাপনা দল, ডাক্তার, নার্স এবং আমার জন্য নিশ্চিতভাবেই সবথেকে কঠিন সময় ছিল। আমাদের প্রায় ১৫০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী ছিল। ফলে সবার মধ্যে প্রচন্ড আতঙ্ক কাজ করছিল। আমি আশা করি আমাদের আর কখনো এধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে না," বলেন তালওয়ার।
তবে, এখনো প্রতিদিন একই ধরনের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। কেননা, দিল্লির হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহের নিশ্চয়তা নেই। "আমরা অক্সিজেন আসার সময় কিংবা পরিমাণ কোনোটাই জানি না," বলেন তিনি।
ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী নয়া দিল্লি এবং অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই এখন লকডাউনের কবলে। মহামারির ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাড়তে থাকা সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রমাগত ধসের মুখে থাকলেও রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত থাকায় মোদির দিকেই এখন অভিযোগের তীর।
"যখন আমাদের হাতে ছয় মাস সময় ছিল এবং সংক্রমণ সংখ্যাও খুব সীমিত ছিল, সে সময় সরকার অক্সিজেন এবং অন্যান্য কাঠামোসম্পন্ন আরও বহু হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারত। এই মুহুর্তে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ প্রয়োজন। সরকারের এখন অন্তত এতটুকু ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত," বলেন ডাক্তার রেজা।
এক সপ্তাহ আগে দিল্লি হাইকোর্ট সরকারের অবহেলায় "বিস্ময় এবং উদ্বেগ" প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনকে তিরষ্কারের মাধ্যমে "ভিক্ষা, চুরি বা ধার" করে যেভাবেই হোক না কেন হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করা হয়। এরপর সরকার "যত দ্রুত সম্ভব" মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের ৫৫১টি মেশিন স্থাপনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে।
এ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আলোচনায় অংশ নেন। বাইডেন ভারতে অক্সিজেন ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন। মোদির প্রশাসন অক্সিজেন উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়াও শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এদিকে, মঙ্গলবার দিল্লির স্থানীয় সরকার জানায় যে, তারা ফ্রান্স থেকে ব্যবহারে প্রস্তুত ২১টি অক্সিজেন উৎপাদনকারী যন্ত্র আমদানি করবে। এছাড়াও, ব্যাংকক থেকে ১৮টি অক্সিজেন ট্যাংকার আনার পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
'তীব্র সংক্রামক'
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, "বর্তমান ঢেউটি বিশেষ বিপজ্জনক- তীব্র সংক্রামক এই ঢেউতে আক্রান্ত হওয়া মানুষ আগের ঢেউয়ের মতো দ্রুত সেরে উঠতে পারছেন না। এই মুহুর্তে সকল হাসপাতাল প্রকৃত ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করে ফেলেছে। আইসিইউ শয্যা থেকে শুরু করে সাধারণ শয্যা পর্যন্ত ফাঁকা নেই।"
মুলচান্দ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা এক রোগীর পাশে বিলাপ করছিলেন এক নারী। পরিবারের অন্য সদস্যরা নিরবে তা দেখছিলেন। ডাক্তার রেজা জরুরি বিভাগের এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড় দেননি। ১৬ শয্যার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়ার্ডটিকে তিনি ২৫ শয্যার ওয়ার্ডে রুপান্তর করেছেন। কিন্তু, তারপরও তিনি চাহিদার সাথে তাল মেলাতে পারছেন না।
"পরবর্তী অক্সিজেন ট্যাংকার কখন আসবে আমরা তা নিয়ে চিন্তা করতে চাই না। প্রতিটি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট চলছে। আমাদের যা আছে, তাই নিয়েই কাজ করে যেতে হবে," বলেন তিনি।
মুলচান্দ হাসপাতালের নার্স ইউনিটের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন সংযোগ নামে এক ব্যক্তি। মানুষকে বাঁচাতে প্রতিদিন তাদের রীতিমতো যুদ্ধ করে যেতে হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ