‘তালেবান কেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে উৎসাহী: সবই অর্থনীতির খেলা!’
আজ আমাদের বলা হচ্ছে, আজকের তালেবান ১৯৯০- এর দশকের মতো নয়। সেকথা মেনে নিয়েও বলা যায়, আজকের আফগানিস্তানও ১৯৯৬ সালের মতো নয়। এবার তালেবান অনেক দ্রুত ও প্রায় বাঁধাহীন ভাবে পুরো দেশ দখল করতে পেরেছে, ৯৬ সালে এত সহজে জয় পায়নি তারা।
কাবুল দখলের পর সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। এবার দেশ শাসনের আসল দায়িত্ব নিতে হবে তাদের। রাজকার্যের দায় বড় দায়; আধুনিক বিশ্বে যা শুনতে সহজ শোনালেও বাস্তবে আরও কঠিন।
১৯৯৬ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ছিল গোটা আফগানিস্তান। বুলেট বা রকেট চালিত গ্রেনেড থেকে রক্ষা পাওয়া ইমারতগুলি হাতেগোনা যেত যেন।
সব অবকাঠামোর তখন ভঙ্গুর দশা, বাঁধগুলো কাজ করছিল না, সড়ক চাপা পড়েছিল ধ্বংসস্তূপে- নাহয় যুদ্ধবাজ, দাঙ্গাবাজ গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে পণ্য বহন বন্ধ হয়ে পড়ছিল। শহরগুলো বোমার আঘাতে তখন ইট-পাথরের স্তূপ। তারমধ্যেই মাথা গুঁজে বাঁচার চেষ্টা করছিল সাধারণ আফগানরা।
এই অবস্থায় কয়েক বছর ধরে বন্ধ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম। সমর্থনকারী কোন কর্তৃপক্ষ না থাকায় জাতীয় মুদ্রা- আফগানির মূল্য তলানিতে পৌঁছাতে থাকে।
১৯৯৬ সালে তালেবান যখন ক্ষমতায় আসে তখন দেশজুড়ে অন্তত চারটি ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রা প্রধান বিনিময়ের মাধ্যমে ছিল। অঞ্চলভেদে কোন মুদ্রার প্রচলন নির্ভর করতো। অর্থনীতির বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো চোরাকারবারি ও চাঁদাবাজেরা। দেশের কোনো স্থানেই উল্লেখযোগ্য কোন স্থায়ী বিনিয়োগ করছিল না কেউ।
১০ লাখ স্কুল শিক্ষার্থীর অধিকাংশই ছিল ছেলে, কিন্তু পুরো দেশেই ভেঙ্গে পড়েছিল শিক্ষা ব্যবস্থা। ছিল না সচল কোন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। এমনই এক আফগানিস্তানকে করায়ত্ত করেছিল তালেবান।
সে তুলনায়, আজ যে আফগানিস্তান তারা দখল করেছে, তার বৈদেশিক রিজার্ভ কমবেশি ৯০০ কোটি ডলার(সবটাই বিদেশে গচ্ছিত)। আছে বেসরকারি খাতের উদ্যোগ, একটি কার্যকর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং মুদ্রা সরবরাহ ও বিনিময় হার নির্ধারণের মতো সহায়ক আর্থিক ব্যবস্থা।
যোগাযোগ খাতেও এসেছে উন্নতি। ২,০০০ কিলোমিটার সড়ক বর্তমানে সব কয়টি প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা দিচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বসানো হয়েছে চারটি দীর্ঘ দূরত্বের ট্রান্সমিশন লাইন। লাইনগুলোর মাধ্যমে চাহিদার সিংহভাগ বিদ্যুৎ প্রতিবেশী তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও ইরান থেকে আমদানি করা হয়।
মার্কিন সরকারের সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হয়েছে এসব প্রকল্প। ফলে আফগানিস্তানের শহরাঞ্চলে আধুনিকতার বিকাশও ঘটেছে দ্রুত। এক কোটি শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ছে এখন, যা অর্থবহ অগ্রগতি।
একথা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত আফগান সরকার ছিল দুর্নীতি ও অযোগ্যতার জন্য সবিশেষ পরিচিত (আসলে কুখ্যাত), প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা সীমাহীন দুর্নীতি করেছে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নজরদারিতে অনেক প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ায় জনগণ সুফল পাচ্ছে।
তাই ঘানি প্রশাসনের এসকল ব্যর্থতা সত্ত্বেও তালেবান আজ যে দেশ দখল করেছে তা ১৯৯৬ সালের তুলনায় অনেক উন্নত ও প্রশাসনিকভাবে বিন্যস্ত।
মার্কিনীদের হাতেগড়া প্রশাসনিক পরিকাঠামো খুব একটা পোক্ত না হলেও, সেটি ভেঙ্গে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছে তালেবান। গত ১৭ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের প্রধান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, "আমরা একটি আধুনিক অর্থনীতি চাই।" আর পলায়মান আফগানদের দেশে থাকার অনুরোধ করে বলেন, "আমরা আপনাদের মেধাকে কাজে লাগাতে চাই।"
আফগানিস্তানের অর্থনীতি:
মুজাহিদ ভুল কিছু বলেননি। সত্যিকার অর্থেই দেশ চালাতে তালেবানের প্রয়োজন দক্ষ প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রশাসক ও আমলা।
কাবুল দখলের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যালয়ে যায় তালেবান, সেখানে গিয়ে ৯০০ কোটি ডলার রিজার্ভ কোথায় আছে সে খোঁজ করে। যদিও ততক্ষণে খাঁচার পাখি পালিয়েছে, তালেবান আতঙ্কে দেশ ছেড়েই পালান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা।
উপস্থিত কর্মকর্তারা তালেবান পরিদর্শক দলকে জানান, রিজার্ভের সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোপন কোনো ভল্টে রাখা নেই, বরং নানা মাধ্যমে (স্বর্ণের বার ও ট্রেজারি বন্ডে) সঞ্চিত আছে নিউইয়র্কে অবস্থিত ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। এসব সম্পদ জব্দ করেছে বাইডেন প্রশাসন। পালিয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহমাদি পরবর্তীতে সিরিজ টুইট বার্তায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
অচিরেই তালেবান উপলদ্ধি করছে দেশ চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন হয়- তার অর্ধেক দেয় দাতা দেশগুলো। ইতোমধ্যেই তারা আফগানিস্তানকে দেওয়া সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এসব সম্পদ ছাড়া তালেবান সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে পারবে না। বিশেষ করে, বকেয়া থাকবে আফগান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বেতন।
বেতনহীন অথচ সামরিক বিদ্যায় প্রশিক্ষিত এসব সদস্য দস্যুদল গড়ে তুলে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে। আবার তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াও মধ্য এশিয়ার বিশাল দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
তালেবান আরো বুঝতে চলেছে যে, কার্যকর আর্থিক ব্যবস্থা বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ শূন্যতায় তারা প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম মেটাতে পারবে না। তালেবান যে রাষ্ট্র দখল করেছে তার ঘাড়ের ওপর বিপুল ঋণের বোঝা। আছে ঋণের সুদ ও অন্যান্য খরচ পরিশোধের বোঝা। এই দেনা এখন তাদের কাঁধে চাপতে চলেছে। এমনকি ২০২১ সালে আফগানিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা ৭০০ কোটি ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তাও ফ্রিজ করা হচ্ছে।
এজন্যেই তালেবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে এত আগ্রহী।
বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের কাছে নমনীয় মনোভাবের বার্তা দিতে কাতারের দোহায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা করছে তালেবান। সবগুলো প্রাদেশিক রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করার পরও এজন্য তারা নিজেদের ইসলামী আমিরাতকে আফগানিস্তানের সরকার বলে এখনো ঘোষণা করেনি।
বৈশ্বিক নির্ভরতা:
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈধতার সিলমোহর ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের নাগাল পাবে না তালেবান। আসবে না দাতা সংস্থার স্থগিত করা সহায়তা। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়ে মাদক ও নিত্যপণ্যের চোরাচালানকারীদের ওপর করারোপের পুরোনো অর্থনৈতিক মডেলে ফিরতে হবে তালেবানকে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক মডেলে আজকের আফগানিস্তানকে পরিচালনার মতো অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
অচিরেই আফগান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তালেবানকে। এই বাহিনীগুলো কী তারা ভেঙ্গে দেবে নাকি বজায় রাখবে? বজায় রাখলে নিজস্ব বাহিনীর সঙ্গে এদের সহাবস্থান কীভাবে নিশ্চিত করবে? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন; সদস্যদের বেতন-ভাতা, আনুষাঙ্গিক খরচ কীভাবে মেটাবে? এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠতে বাধ্য, কারণ প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক, কাগজেকলমে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিন লাখের কম নয়।
অভিযোগ আছে, কাগুজে হিসাবে দেখানো প্রতি ছয়জন সৈনিকের মধ্যে মাত্র একজন বাস্তবেই কর্মরত ছিলেন। তাহলেও ৫০ হাজার সশস্ত্র সদস্যের এক বাহিনী দাঁড়ায়- যা আদতে তালেবানের মূল যোদ্ধা সংখ্যার চেয়ে সামান্য কম। এই বাহিনীগুলোর ভবিষ্যতের প্রশ্ন তাই কোনো অংশেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
মার্কিনীরা যখন ইরাক দখল করেছিল এক্ষেত্রে সে সময়ের তুলনা দেওয়া হচ্ছে। তখন প্রবল জন-প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল আগ্রাসী বাহিনী। আর আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে হন্যে হয়ে ফিরছিল বুশ প্রশাসন। কারণ, তারা উপলদ্ধি করেন, বহির্বিশ্বের সমর্থন ছাড়া বাগদাদে বসানো পুতুল সরকার টিকতে পারবে না।
বাগদাদ পতনের পরবর্তী সংকটগুলো মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্র, ফলে ইরাক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেদিক থেকে আশার কথা হলো, কোনো পক্ষই তালেবান সরকার ব্যর্থ হোক তা চায় না। তাদের জানা আছে, আফগানিস্তান তাতে করে নৈরাজ্যের অন্ধকূপে ফিরে যাবে, বন্ধ হবে না অস্ত্রের ঝনঝনানি। গৃহযুদ্ধ দেশটিকে তলিয়ে নেবে অন্ধকার যুগে। পরিণত হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ডেরায়- আর সেখানেই বড় ভয় সবার।
শত্রুমিত্র নির্বিশেষে সকলের এ প্রত্যাশার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করছে তালেবান। বৈধতা পেলে তারপর সাহায্যের আবেদনও করবে, এবং তাদের জানা আছে অনুদান ও ঋণ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা প্রায় অসম্ভব।
- লেখক: খুররম হোসেন পাকিস্তানের শীর্ষ ইংরেজি ভাষার দৈনিক দ্য ডনের ব্যবসা ও অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিক।
- সূত্র: দ্য ডন