‘বাইডেনকে ভারতের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে’
নতুন করে কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াল উৎপত্তিস্থলে রূপ নিয়েছে ভারত। দৈনিক শনাক্ত ৩ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও প্রতিদিনই বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক মৃতের সংখ্যা দৈনিক ২ হাজারের বেশি বলা হলেও, নিশ্চিতভাবেই তা আসল সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। প্রতিঘণ্টার খবরে আসছে মৃতদের গণদাহ, ভিড়ে বিশৃঙ্খল কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র এবং হাসপাতালের শয্যার অপেক্ষায় থাকতেই থাকতেই অজস্র রোগীর মৃত্যুর নিত্যনতুন সংবাদ। এই মুহূর্তে যে কথাটি নিঃসঙ্কোচে বলা উচিৎ, তা হলো ভারতের জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন, আর যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ সে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
বিভিন্ন সময় নানা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মজুত বিশাল সংখ্যক টিকার ডোজ দরিদ্র দেশকে সহায়তা হিসেবে দেওয়ার অনুরোধ উঠেছে, যদিও প্রতিবার সেগুলো নাকচ করে দিয়েছে জো বাইডেনের প্রশাসন। অবশ্য, প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর জন্য সামান্য ব্যতিক্রমী বদান্যতা দেখিয়েছে মার্কিন সরকার। বিশ্বের বাকি দেশগুলো কেন পাবে না- তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে, এমন মুহূর্তে যখন শুধু ভারতে নয়, বরং ব্রাজিলেও মারাত্মক আকার নিয়েছে মহামারি। সেখানকার আনুষ্ঠানিক মৃতের সংখ্যা ভারতের চাইতেও বেশি। আবার ভ্যাকসিন সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশ। সেই তুলনায় শক্তিশালী স্থানীয় ওষুধ শিল্পের সুবাদে ভারতের সক্ষমতা আছে প্রতি মাসে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের।
তারপরও, ভারতের সঙ্কটকে গুরুতর হিসেবে আমলে নেওয়ার জন্য বাইডেন প্রশাসনের নিকট বেশকিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ সঙ্কটের সুবিশাল আকার। যেমন ভারতের মাত্র একটি রাজ্য উত্তর প্রদেশে ব্রাজিলের সমান জনসংখ্যার বসবাস। আবার ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই যে রাজ্যে অবস্থিত সেই মহারাষ্ট্রের জনসংখ্যা দ. আফ্রিকার দ্বিগুণ। অর্থনীতি অচল হওয়ায় আবারও দলে দলে গ্রামে ছুটে যাচ্ছে লাখো পরিযায়ী শ্রমিক। কুম্ভ মেলা শেষে ঘরে ফিরে এসেছে লাখো পূণ্যার্থী- যাদের কারণে ১৩০ কোটি জনসংখ্যার বাসস্থান গ্রাম ও মফস্বলেও ভাইরাসের ভয়ঙ্কর বিস্তার দানা বাঁধার চাপা আশঙ্কা বিরাজ করছে।
সেই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে ভারতের দুর্বল জনস্বাস্থ্য খাত সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়বে। স্বাস্থ্যখাতের এই নাজেহাল দশা হবেই বা না কেন! জনসংখ্যা সমান হওয়ার পরও ব্রাজিলে মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা বরাদ্দ উত্তর প্রদেশের ৪০ গুণ বেশি। প্রতি লাখ ব্রাজিলীয়র জন্য আছেন ২১৪ জন চিকিৎসক, উ. প্রদেশে সেই সংখ্যা ৩৯ জন। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে ব্রাজিলের চাইতে সরকারি হাসপাতালে শয্যার মাথাপিছু সংখ্যাও অর্ধেকের কম। সংক্রমণ সংখ্যা যেভাবে লাগামহীন গতিতে বাড়ছে, তাতে অচিরেই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য হারাবে ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলো।
ভারতের এই বিপর্যয় বিচ্ছিন্ন কোনো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি হবে না, বরং তার পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য ডেকে আনতে পারে অশুভ পরিণতি। ভারতে যে ধরনটি সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গকে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতোমধ্যেই সেটি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে শনাক্ত হয়েছে। তাই ভারতে মহামারি যতদিন অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলবে, ততোটাই বাড়বে ভাইরাসের আরও মারাত্মক অভিযোজন ও তা দুনিয়াজুড়ে বিস্তার লাভের সম্ভাবনা।
সবশেষের কারণটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো মহামারির বিস্তার রোধে ভারতের বৈশ্বিক ভূমিকা। ভারতে সস্তায় উৎপাদিত ভ্যাকসিন ডোজ সরবরাহ পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে উন্নয়নশীল বিশ্ব। কিন্তু, দেশটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রায় সকল ডোজ ব্যবহার করায় রপ্তানি রয়েছে বন্ধ। মুখাপেক্ষী দেশগুলোকে তাই টিকাদান শুরুর জন্য আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। আবার মহামারির উপদ্রুপে যদি ভারতীয় ওষুধ সংস্থাগুলোর উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে বিশ্ব বাজারে নন-কোভিড ওষুধপত্রের জোগানও সীমিত হয়ে আসবে। যেমন- প্রচলিত অনেক রোগের টিকা উৎপাদনে বিশ্বের বৃহত্তম সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, তাদের উৎপাদিত টিকা দিয়েই বিশ্বের অর্ধেক সংখ্যক শিশুকে হাম, যক্ষ্মা, মাম্পস প্রভৃতি রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখা হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সম্পদশালী দেশের সরকার হিসেবে বাইডেন প্রশাসন দুভাবে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। প্রথমটি হলো; টিকা উৎপাদনের অতি-দরকারি কাঁচামাল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ইতোপূর্বে, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোতে কাঁচামালের সরবরাহ প্রাধান্য দিয়ে ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্টের আওতায় রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
অথচ ভ্যাকসিন উৎপাদনে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুমোদিত বিশেষ কিছু উৎপাদনের ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। মহামারির মধ্যে এসব উপকরণ বিকল্প উৎস দ্রুত থেকে সংস্থান করাটা দুরূহ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে জারি করা আইনটির কারণে সেদেশের উৎপাদকদের জীবাণু প্রতিরোধী বিশেষ ফিল্টার, সেল কালচারে ব্যবহৃত ডিজপোজেবল ব্যাগ, সেল কালচার মিডিয়া এবং সিঙ্গেল ইউজ টিউবিং- এর মতো উপাদান রপ্তানির আগে সরকারি অনুমোদন নিতে হচ্ছে। এই অনুমোদনের প্রক্রিয়ার কারণেই সরবরাহ প্রবাহে সঙ্কোচন দেখা দিয়েছে।
সেরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, এই উপকরণগুলোর সুষ্ঠু সরবরাহ ছাড়া আগামী মাস নাগাদ তারা ১৬ কোটি প্রতিষেধক ডোজ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
দ্বিতীয় সাহায্যটি যুক্তরাষ্ট্র করতে পারে তাদের প্রাপ্য চালান থেকে অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন টিকার ডোজ জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহের মাধ্যমে। মার্কিন নিয়ামক সংস্থা অনুমোদন না দিলেও ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ২ কোটি ডোজের এক বিশাল মজুত গড়ে তুলেছে। বিদ্যমান চুক্তির আওতায় দেশটি চাইলে আরও ৩০ কোটি ডোজ অর্ডার করার অধিকার রাখে। আর জনসন ভ্যাকের ১০ কোটি ডোজ ক্রয়ের চুক্তি করেছে, যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে সেখানকার অনেক নাগরিকই এই টিকা নিতে ভয় পাচ্ছেন।
মানবিক সঙ্কটের এই মুহূর্তে গুদামে ফেলে রাখার পরিবর্তে চাইলেই এসব মজুত থেকে ভারতকে সাহায্য করতে পারে বাইডেন প্রশাসন। এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান টিকাদান কর্মসূচিতেও কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, এ দুটি ভ্যাকসিন ছাড়াই সেখানে টিকাদান হার জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে, ভারতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সেরামের উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ডোজ। আবার স্থানীয় আরেকটি কোম্পানি বায়োলজিক্যাল-ই লিমিটেড জনসন ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করেছে। ভারতের বর্তমান সঙ্কট কেটে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্রের যদি সত্যিই দরকার হয়, তাহলে ভারতীয় উৎপাদকেরা মার্কিন ভাণ্ডারকে পূর্ণ করে দিতে পারবে।
সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে বাইডেন প্রশাসন। একইসঙ্গে, সমগ্র বিশ্বকেও টিকার আওতায় আনার গুরুত্ব অনুধাবনের দাবিও জানিয়েছে। সমতার ভিত্তিতে স্বল্প আয়ের দেশে টিকার ডোজ সরবরাহের লক্ষ্যে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগেও অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়েছে মার্কিন সরকার। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন বিরোধী কোয়াড রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে নিয়েছে টিকা বণ্টনের উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতও কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং ন্যাটো জোটের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র।
কোভ্যাক্স ও কোয়াডের মাধ্যমে সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগের সুফল পেতে দীর্ঘসময় লাগবে, আর তা অনেকাংশে নির্ভর করছে ভারতীয় উৎপাদকদের সক্ষমতার উপর। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নেও যুক্তরাষ্ট্রকে জরুরি ত্রাণ নিয়ে ভারতের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।
- শ্রুতি রাজাগোপালান যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কাটাস সেন্টারে জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন।