‘ভ্যাকসিন যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী কোভিড-১৯’
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সফল টিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে, অনুমোদনও পেয়েছে বেশ কয়েকটি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বজুড়ে মরণ কামড়ের মাত্রা বাড়িয়েছে কোভিড-১৯। বাদ পড়েনি ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের আরও উত্থান; পৃথিবীবাসী যখন মহামারির অবসান চান, ঠিক সেই মুহূর্তেই এটি জোরালো হয়ে উঠছে।
নির্ভরযোগ্য জীবনদায়ী ওষুধটি এখনও সহজলভ্য নয়। উৎপাদক পর্যায় থেকে সীমিত সরবরাহ থাকায়, অন্যদেশের আগে চালান নিশ্চিত করাটাই চ্যালেঞ্জ।
তাই উন্নত দেশে বাড়ছে আরও বেশি ডোজ কিনে রাখার প্রলোভন। অথচ তারা এমন সিদ্ধান্ত নিলে টিকা সঙ্কটে পড়বে মধ্য ও স্বল্প আয়ের দেশ। মহামারিও দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য।
তাই মূল লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা থাকা উচিৎ উৎপাদন বৃদ্ধিকে ঘিরে। উৎপাদন বাড়িয়ে তা সকল দেশে সমতার ভিত্তিতে সরবরাহের ব্যবস্থা না করা গেলে; আমাদের ধারণার চাইতেও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস বিশ্ববাসীর যন্ত্রণার কারণ হবে।
জাতীয়তাবাদী ক্ষোভের উত্তাপ বাড়ার কারণই- সরবরাহের স্বল্পতা। সম্প্রতি প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রতিষেধকের ডোজ সরবরাহ করতে না পারার কথা ইউরোপিয় ইউনিয়নকে জানায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি, যা ব্লকটিকে ভীষণ ক্ষুদ্ধ করে। ফলশ্রুতিতে, রপ্তানি বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে ইইউ। কম ডোজ সরবরাহ করে কোম্পানিটি যদি চুক্তিতে উল্লেখিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, এবং তা আইনত প্রমাণ হয়; তাহলে ইইউভুক্ত অঞ্চলের কারখানায় উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ডোজ, ইইউ এর বাইরে কোথাও রপ্তানি করা যাবে না।
ইইউ বাণিজ্য বিষয়ক কমিশনার ভালদিস দমব্রোভকিস বলেন, "টিকাদান সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা। সময়মতো ভ্যাকসিনের চালান না পেয়ে আমরা সময় নষ্ট হতে দিতে পারি না।" তবে ইইউ ব্লকের কিছু প্রতিবেশী এবং স্বল্প আয়ের দেশের ক্ষেত্রে রপ্তানি কঠোরতায় ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি।
তাত্ত্বিকভাবে, এই সিদ্ধান্তে অন্যায় কিছু ধরার জো নেই। করদাতাদের অর্থে অগ্রিম মূল্যে কেনা টিকার সব ডোজ যেন পাওয়া যায়, অবশ্যই সেটা ওই কর দাতাদের স্বার্থেই নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। যেমন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও সতর্ক করে বলেছে, উৎপাদক সংস্থাগুলো যথেষ্ট পরিমাণে ডোজ প্রস্তুত না করলে, একটি বিশেষ আইনবলে সরকার তাদের মেধাস্বত্ব অধিকার নিজ আয়ত্বে নিয়ে নেবে।
আসলে, পশ্চিমা কর্তৃপক্ষকে মরিয়া করে তুলেছে সংক্রমণের সর্বশেষ ঢেউ। ইইউ'ভুক্ত সকল দেশে এখন মোট প্রাণহানির সংখ্যা ৪,৬২,৮০০টি। আর ইউরোপ মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল লকডাউন বিধি-নিষেধের আওতায়। তাই কর্তৃপক্ষের জন্য মরিয়া হওয়ার ন্যায্য এবং চুক্তিতে করার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে আইনি অধিকারও আছে।
তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছেড়ে বাস্তবের দিকে মনোযোগ দিলে দেখা যাবে, এসব সিদ্ধান্তের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এবং তাতে বিশ্বজুড়ে জীবন-মরণ সঙ্কটটি লাভ করবে আরও বেশি তীব্রতা। অন্য কোথাও পাঠানোর জন্য উৎপাদিত ডোজ কারখানা পর্যায়ে জব্দ করার অর্থ: গন্তব্যের দেশকে প্রাণদায়ী ওষুধ থেকে বঞ্চিত করা। এরফলে, পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হবে। গত বছর মাস্ক এবং ভেন্টিলেটরের সরবরাহ নিয়ে এমন এক লড়াই দেখা গিয়েছিল।
ইইউ এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই কানাডীয় সরকার জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেছে, ব্লকটির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কানাডায় চালানের পরিমাণে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। তবে একইসঙ্গে, ইইউকে সতর্ক করে বলেছে, তারা যেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে কানাডীয় সরকারের করা চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করে।
ডেইলি মেইল দেশটির কর্তৃপক্ষের বিবৃতি তুলে ধরে; "না ইইউ আমাদের প্রাপ্য ডোজ থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। ভারত বিশ্বের টিকা সরবরাহের অর্ধেক উৎপাদন করে। তারা যদি এখন ইইউ' এর সিদ্ধান্তে উৎসাহী হয়ে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেয়- তাহলে কী হবে?"
অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে ইইউ এর করা চুক্তির শর্ত অনুসারে এগোলেও হিতে-বিপরীতের ঝুঁকি বেশি। প্রকাশিত চুক্তিপত্রে দেখা গেছে, ব্রিটিশ-সুইস মালিকানার কোম্পানিটি সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার অঙ্গীকার করেনি। এনিয়ে বিচারিক পর্যায়ে যে প্রশ্ন নেবে, সেটা আইনজীবীদের লড়াইয়ের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে পারে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে কানাডার মতো অনেক দেশ ইইউ এর আগেই বেশি দামে ডোজ ক্রয় করেছে অগ্রিম অর্থে। এমনকি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গবেষণায় অর্থায়নও দিয়েছে। তাই আইনি বিচারে রপ্তানি সীমাবদ্ধতার চুক্তি বৈধতা না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া, অন্যান্য দিকেও নজর দেওয়া দরকার। যেমন ফ্রান্সের জৈব-প্রযুক্তি কোম্পানি ভ্যালনেভা যুক্তরাজ্যে তাদের আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ টিকার ৬ কোটি ডোজ রপ্তানির চুক্তি করেছে। চুক্তিমূল্য ৪৭ কোটি ইউরো বা ৫৭ কোটি মার্কিন ডলার। চুক্তির আওতায় স্কটল্যান্ডে অবস্থিত কারখানার সক্ষমতা বাড়াতে সরকারি তহবিল সহায়তাও পেয়েছে কোম্পানিটি।
ভ্যালনেভার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা জানান, ইইউ' এর সঙ্গে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর লক্ষ্যে তারা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, নিষেধাজ্ঞার ফলে দ্রুত চালান সরবরাহ করা যাবে না। কিন্তু, ইইউ যদি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হবে।
এতো গেল উন্নত বিশ্বের দ্বন্দ্বের সাম্প্রতিক চিত্র। অথচ বৈশ্বিক পর্যায়ে টিকাদান কেবল এক মাসের কিছু বেশি সময় পার করেছে। এখনও সম্পূর্ণ হওয়া বাকি চীন ও ভারতের মতো বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশে। এছাড়া, ২০২৩ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮৫টি দরিদ্র দেশ টিকার আওতায় আসবে এমন ধারণাও করা হচ্ছে।
নাগরিকের টিকাদান নিশ্চিত করতে অবশ্যই সরকারের বাধ্য-বাধকতা রয়েছে। কিন্ত, উন্নত বিশ্বের সরকারের মাথাব্যথা যেন দরিদ্র দেশের কর্তৃপক্ষের ঘাড়ের বোঝা না হয়, সেদিকটাও লক্ষ্য রাখা উচিৎ। নাহলে বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চল টিকাবিহীন এক ঘোর অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়বে। আবির্ভাব হবে জীবাণুর আরও নতুনতর ও শক্তিশালী ধরন। সেই অভিজ্ঞতা কারো জন্যেই সুখকর হবে না।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- লেখক: ব্লুমবার্গের ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং ফ্রান্স বিষয়ক মতামত কলাম লেখক। তিনি ইতোপূর্বে, রয়টার্স ও ফোর্বসে কর্মরত ছিলেন।