চীন কেন তার আসল প্রতিরক্ষা বাজেট গোপন রাখে?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সামরিক বাহিনীর দ্রুত সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এটি যে ব্যয়বহুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু চীন সবসময়ই এ ব্যাপারটিকে গোপন রাখতে চায়। চীনের দাবি, তার সামরিক খরচ আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেটের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
চীনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ১.২৬৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা প্রায় ১৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে, একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৭৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। দুই দেশের সামরিক ব্যয়ে এমন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও; গত দুই দশক বা তারও বেশি সময় ধরে চীন বিশ্বের বৃহত্তম নৌ ও সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, উন্নত স্টিলথ এয়ারক্রাফ্ট প্রযুক্তি এবং হাইপারসনিক অস্ত্রের ক্ষেত্রেও আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন।
কিন্তু এটি কীভাবে সম্ভব? আমেরিকা প্রতি বছর শুধু তার ফেডারেল ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ যে পরিমাণ বরাদ্দ রাখে, তার চেয়েও কম প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে চীন কীভাবে বেশকিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার সামরিক ক্ষমতার সমান হতে পারে? শুধু তাই নয়, চীন অনেক ক্ষেত্রেই এখন মার্কিন সামরিক সক্ষমতাকেও ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের সমন্বয় রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের সৃজনশীল হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি, অসততা (প্রকৃত বরাদ্দের তথ্য গোপন) এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গোপনীয় কিছু পন্থার সমন্বয়েই চীন তথাকথিত কম বাজেটে আধুনিকায়ন করে চলেছে তার সামরিক বাহিনী।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (চীনের সামরিক বাহিনী) এবং আমেরিকার সামরিক বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি হলো, বিশ্বব্যাপী এদের পরিধির বিস্তৃতি। আমেরিকার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে প্রায় পুরো বিশ্বজুড়ে। নৌ, বিমান ও স্থল পর্যায়ে মার্কিন সেনারা বিশ্বজুড়ে তাদের মিত্র দেশগুলোর সাথে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের সামরিক বাহিনী শুধু আঞ্চলভিত্তিক নিরাপত্তার জন্যই কাজ করছে। প্রশান্ত মহাসাগর এবং বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরই তাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র।
প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে চীন:
এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই; চীন প্রতি বছর তার সামরিক খাতে আসলে কতটা ব্যয় করে- সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয় না। আইনপ্রণেতাদের জবাবদিহিতার জন্য উন্মুক্ত কোনো গণমাধ্যম ব্যবস্থাও নেই সেখানে। সরকার দেশের প্রতিরক্ষা বাজেট হিসেবে যা ঘোষণা করে, সেটিকেই চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এখানে তথ্য কিংবা প্রমাণাদির কোনো বালাই নেই।
বিদেশি পর্যবেক্ষকরা চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয়কে তাদের দাবির চেয়ে কিছুটা বেশি বলেই মনে করেন। যদিও এই ব্যয় এখনও আমেরিকার ৭০০ বিলিয়ন বাজেটের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি, তারপরেও চীনের দাবি অনুযায়ী ১৯৬ বিলিয়নের ছোট বাজেটও নয় বলে মনে করেন তারা।
যেমন ২০১৯ সালে চীনের দাবিকৃত প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ১৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই বা সিপ্রি) বিশ্লেষকদের মতে, এটি অন্তত ২৬ হাজার ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি ছিল।
অর্থাৎ, ২০১৯ সালে চীন তার প্রকৃত বাজেটের ৪১ শতাংশ গোপন রেখেছিল। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)-এর বিশ্লেষণে চীনের দেওয়া ও দাবি করা পরিসংখ্যানগুলোর বেশিরভাগই বিশ্লেষকদের কাছে ভুল বলে মনে হয়েছে। এই সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সালে চীন তার সামরিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশ কম দেখিয়েছে।
২০২০ সালেও চীনের দাবি অনুযায়ী, তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ১৯৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিশ্লেষকদের হিসাব মতে, এই বাজেট ২৫৪.৮ বিলিয়ন থেকে ২৭৬.৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, এবারও দেশটি তার প্রকৃত প্রতিরক্ষা বাজেটের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ গোপন রেখেছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে আধাসামরিক সংস্থাগুলোকে আড়াল রাখে চীন:
আরও জটিল বিষয় হল, চীন তার আধাসামরিক সংস্থাগুলোর ব্যয়কে সামরিক ব্যয় হিসেবে লিপিবদ্ধ করে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি চীনের ভুল নয়; বরং ইচ্ছাকৃত একটি প্রচেষ্টা।
এই সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের বিশাল স্থল ও নৌ মিলিশিয়া, সামরিকায়িত কোস্ট গার্ড এবং এমনকি পিপলস আর্মড পুলিশ (পিএপি) বাহিনী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও বিশাল পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তবে এখানে দুই দেশের সামরিক ব্যয়ের পরিসংখ্যান ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভিন্ন হতে পারে। চীনের পিপলস আর্মড পুলিশের স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহিতার কোনো নিয়ম নেই। অন্যান্য সামরিক সংস্থাগুলোর মতোই তারা দেশের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের (সিএমসি) কাছে জবাবদিহি করে। অথচ এই বাহিনীকে সামরিক বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করে না চীন।
উদাহরণস্বরূপ; ২০১৯ সালের বাজেটের কথাই বলা যেতে পারে। চীনের সামরিক বাহিনী পরিচালিত পিএপি বাহিনীর বাজেট ছিল ২৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু পিএপি'র এই বাজেট মূল প্রতিরক্ষা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়নি।
এছাড়া, চীনের জিনজিয়াং প্রোডাকশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কর্পস বা এক্সপিসিসি-কেও চীনের সামরিক বাহিনীরই একটি অংশ বলা যেতে পারে। কারণ এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ২ মিলিয়নেরও বেশি সদস্যদের প্রত্যেকেই যোগদানের পর মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। এছাড়া, এক্সপিসিসি জিনজিয়াং প্রদেশে ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প নির্মাণ ও সেগুলো পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। এই প্রদেশে উইঘুর ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের আন্তর্জাতিক অভিযোগ রয়েছে চীন সরকারের বিরুদ্ধে। তবে, এই বাহিনীর বরাদ্দকৃত বাজেটকেও চীন তার মূল প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে আড়াল রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় বেতন খাতে অনেক কম ব্যয় করে চীন:
মার্কিন সেনাদের বেতন ভাতার তুলনায় চীনের সেনাদের বেতন অনেক কম। এটিও চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট কম হওয়ার পেছনে যথেষ্ট অবদান রাখছে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনা সরকার ঘোষণা করেছিল, বছর শেষের আগেই পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) সদস্যদের ৪০ শতাংশ বেতন বাড়ানো হবে। এই ঘোষণায় খুশি হয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্নেল বলেছিলেন, "আমি খুবই খুশি কারণ বেতন বৃদ্ধির পরে আমি ৭ হাজার ইউয়ান (১ হাজার মার্কিন ডলার) পর্যন্ত বাড়তি আয় পেতে যাচ্ছি। আমার বেতনের ৪০ শতাংশ বাড়ল, আমার মাসিক আয় ২০ হাজার ইউয়ানের বেশি হয়েছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার বক্তব্যেই বোঝা যাচ্ছে বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকান মুদ্রায় এক চীনা ইউয়ানের মূল্য প্রায় ১৬ সেন্ট। তার মানে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির একজন কর্নেল প্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার ১০৫ ডলার এবং বছরে প্রায় ৩৭ হাজার ২৬০ মার্কিন ডলার আয় করেন। চায়না অ্যারোস্পেস স্টাডিজ ইনস্টিটিউটে ড. মার্কাস ক্লে'র লেখা আরেকটি প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, মার্কিন সেনাবাহিনীতে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের সমতুল্য চীনা কর্মকর্তা বছরে ৪২ হাজার ডলারেরও কম আয় করেন।
কর্মস্থল ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মূল বেতন ও ভাতা মিলিয়ে একজন বিবাহিত মার্কিন মেরিন সদস্য মাসে ৩ হাজার ৬৫০ ডলারের বেশি বেতন পান, এবং বছরে পান ৪৩ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, একজন নতুন মেরিন সদস্য প্রতি বছর চীনা সামরিক বাহিনীর একজন পদস্থ কর্নেলের চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করেন।
চীনের সামরিক সদস্যদের প্রশিক্ষণ খাতেও ব্যয় কম:
চীন সরকার কেবল সামরিক সদস্যের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাই কম দেয় না, বরং সৈন্যদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্যভাবে কম খরচ করে থাকে। বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, চীনা সৈন্যরা তাদের সামরিক পেশায় নিযুক্ত হওয়ার সময় প্রশিক্ষণ পান খুবই কম; এমনকি এরপর তাদের সামরিক ক্যারিয়ারের পরিধি জুড়ে ধারাবাহিকভাবেই তারা মার্কিন বাহিনীর তুলনায় কম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।
প্রশিক্ষণের সময়ের এই বৈষম্যটি ফাইটার পাইলটদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। চীনের পাইলটদের যুদ্ধের প্রস্তুতি ইউনিটে তাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার আগেই প্রায় ২৭৮ ঘন্টা ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। অন্যদিকে, আমেরিকান ফাইটার পাইলটরা কাজে যোগ দেওয়ার পর যে ধরনের বিমান চালাবেন, সেই বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জনেই ২৫০ থেকে ৩০০ ঘন্টার প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করেন। অভিজ্ঞতাগত বৈষম্যের শুরু এখান থেকেই।
গত বছর, মার্কিন বিমান বাহিনীর ফাইটার পাইলটরা তাদের বিমানে গড়ে ২২৮ থেকে ২৫২ ঘন্টা ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। অন্যদিকে, চীনের পাইলটের ক্ষেত্রে এই সময়টি ছিল গড়ে মাত্র ১০০ থেকে ১১০ ঘণ্টা। অর্থাৎ আমেরিকান পাইলটরা তাদের সমবয়সী চীনা পাইলটদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি সময় বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
এখানে সামরিক বাজেটের ক্ষেত্রে এই প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি এফ-২২ র্যাপটর আকাশে ওড়াতে প্রতি ঘন্টায় ব্যয় হয় প্রায় ৭০ হাজার মার্কিন ডলার, যা নিঃসন্দেহে প্রশিক্ষণের খরচকে বাড়িয়ে তোলে।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বাকি সদস্যদের ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণের এই বৈষম্য রয়েছে। ২০১৮ সালে চীন তার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের সময়সীমা তিন মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করেছে। সেই ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরে, সৈন্যরা তাদের নিজ নিজ ইউনিটে যোগদান করেন এবং সেখানে তাদের ওপর যে ধরনের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেগুলো তারা পালন করেন।
মার্কিন সামরিক সদস্যদের প্রশিক্ষণকাল চীনের তুলনায় অনেক বেশি। বিভিন্ন শাখায় পেশাগত বিশেষত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণের সময়কাল ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া, অন্যান্য কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণের মেয়দ দুই বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল সামরিক সদস্য তাদের প্রথম ইউনিটে যোগ দেওয়ার আগে অবশ্যই পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন থাকেন।
- সূত্র: দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট