ভারতের সবচেয়ে বড় নির্বাচনের মূল চাবিকাঠি কী? চাকরি, চাকরি, চাকরি...
ভারতের রাজ্যসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের বাকি সময়টুকু কতটা কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি।
যে পাঁচটি রাজ্যে ভোট গ্রহণ হচ্ছে, তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের গুরুত্ব স্পষ্টতই বাকিদের চেয়ে বেশি।
সংক্ষেপে ইউপি নামে পরিচিত এই রাজ্যের জনসংখ্যা ব্রাজিলের চেয়েও বেশি। অনেক ভারতীয়ই এই রাজ্যকে দেখেন দেশের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রভূমি হিসেবে। মোদিসহ ভারতের সিংহভাগ প্রধানমন্ত্রীই নির্বাচিত হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী এলাকা থেকে।
রাজ্যসভার ৫৪৩ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৮০ জনই আসে ইউপি থেকে। তাই এই প্রদেশের ভোটের রায় ভারতের যেকোনো নির্বাচনের জন্যই মহাগুরুত্বপূর্ণ।
গত পাঁচ বছর ধরে এই রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ইউপিতে মোদির জনপ্রিয়তার কারণেই টানা দুইবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তার দল। ১৯৭০ সালের পর এরকম প্রদর্শনী দেখাতে পারেননি আর কোনো প্রধানমন্ত্রী।
মোদি নিজে ব্যালটে না থাকলেও চলমান ভোটে আবারো পরীক্ষার মুখে পড়বে তার সেই জনপ্রিয়তা। পরাজয় বা ছোট ব্যবধানের জয়ও মোদির অজেয় প্রতিমূর্তিকে ধ্বংস করে দিবে।
যদিও এই নির্বাচনের প্রচারণাতেও সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ঘৃণাত্মক বক্তব্যই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে একটি জিনিসের উপরই। তা হচ্ছে, ইউপির ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি। গত পাঁচ বছরে রাজ্যের অর্থনীতি বা অন্য কোনো খাতে তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি বিজেপি। এই রাজ্যের মাথাপিছু আয় জিম্বাবুয়ের চেয়ে কম এবং হাইতির চেয়ে কিছুটা বেশি।
ইউপিতে বেকারত্বের হারও প্রবল। জানুয়ারি মাসে ইউপি এবং প্রতিবেশী প্রদেশ বিহারে রেলওয়ের ৩৫ হাজার নিম্ন-স্তরের চাকরির জন্য এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি আবেদন জমা পড়ে। এই স্বল্প বেতনের চাকরিকে ঘিরেই এক পর্যায়ে দাঙ্গা শুরু করে দেন আবেদনকারীরা। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো এই ঘটনাকে "ভারতের প্রথম বড় পরিসরের বেকারত্ব দাঙ্গা" বলে আখ্যা দেয়।
প্রায় এক দশক আগে যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নেমেছিলেন মোদি, তখন তার মূল প্রচারণা বক্তব্য ছিল এমন- ইউপিসহ ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশগুলোকে গুজরাটে পরিণত করবেন তিনি। এর আগে সমৃদ্ধ উপকূলীয় রাজ্য গুজরাটকে তিন মেয়াদে শাসন করেছেন তিনি।
গুজরাটের মতো এসব রাজ্যেও কারখানা স্থাপন করতে কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য বিজেপি সরকার বেশ কিছু মহাসড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। পুনঃনির্বাচিত হলে এই প্রয়াসকে আরও জোরদার করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। ছয়টি নতুন মেট্রো, পাঁচটি নতুন এক্সপ্রেস হাইওয়ে, দুটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ২৫টি নতুন বাস টার্মিনাল নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মোদির দল।
কিন্তু গুজরাটের তুলনায় ইউপি এবং বিহারের মতো রাজ্যগুলোয় নতুন চাকরি তৈরি করা বেশ কঠিন। কেননা, গুজরাটে একটি দীর্ঘ অংশ সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত এবং আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে এই রাজ্যের পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে। সারা বিশ্বের মতো ভারতের ক্ষেত্রেও উপকূলীয় অঞ্চলে চাকরি এবং কারখানার সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। কেননা, এসব অঞ্চলের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সংযোগ বেশি ও এখানে বিনিয়োগের সুযোগও বেশি।
তবে সংযোগের অভাবই ইউপির একমাত্র সমস্যা না। এই রাজ্যের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা এবং শাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই দুর্বল। এসব সমস্যা যদি অলৌকিকভাবে সমাধান হয়েও যায়, তবুও কোনো বিনিয়োগকারীর নিকটতম গভীর জলবন্দর থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে এসে এই রাজ্যে নতুন কারখানা স্থাপন করার সম্ভাবনা কমই থেকে যাবে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারলে সরকার উত্তরপ্রদেশে নতুন চাকরি তৈরির চিন্তা না করে উত্তরপ্রদেশের মানুষজনের জন্য নতুন চাকরি তৈরির চিন্তা করবে। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত রাজ্যের কর্মীদের আরও প্রশিক্ষিত করা, তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো। এরপর সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, এসব শ্রমিক যেন সহজে তাদের কর্মস্থলে যাতায়াত করতে পারেন।
কিন্তু ইউপির রাজনীতিবিদরা এগুলো না করে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা পাবলিক সেক্টর সম্প্রসারিত করে ও আরও বিমানবন্দর নির্মাণ করে বহির্গমনের অবসান ঘটাবেন। বলতে গেলে, দেশের শত বছরের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে লড়াই করছেন তারা। তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনার উপর বাজি ধরতে পারছি না আমি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ।
- লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।