বিজেপির হিন্দুত্ববাদ কী প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার দর্শন?
ভারতের পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন চলছে , এমন অবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা ১৮০ মিলিয়নেরও বেশি ভোটার কীভাবে দেখবে।
১৯৮৯ সাল থেকেই বিজেপির মূলমন্ত্র হিন্দুত্ববাদ। অতীতে আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদী নীতির ওপর দাঁড়িয়ে সাফল্য পেয়েছে বিজেপি। তবে, বিরোধীরা বলছে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে দলটির অতি-জাতীয়তাবাদী বক্তব্য দেশটির সংবিধানের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংকটে ফেলে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজেপি হিন্দু ধর্মের রাজনীতিকরণের সাথে সাথে আরও আক্রমণাত্মক সব নীতির আশ্রয় নিয়েছে, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় বলছে এরফলে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পুরোহিত ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর অন্যতম পরিচিত মুখ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সম্প্রতি তিনি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে ৮০ শতাংশ বনাম ২০ শতাংশ বলে অভিহিত করেছেন। যা সরাসরি রাজ্যটির হিন্দু মুসলিমের সংখ্যাকে নির্দেশ করে।
ভারতে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা:
২০১৯ সালে বিজেপি আবারও নির্বাচিত হওার পর হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
ওই বছরই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস হয়, এর মাধ্যমে ২০১৫ সালের আগে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অভিবাসীদের এই আইনের আওতায় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে এসব দেশ থেকে আগত মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
২০২০ সালে দিল্লির মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো সহিংসতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়, সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ থেকে যার সূত্রপাত হয়েছিল। প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মুসলিমদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে।
দুই দিনের সহিংসতায় হিন্দু-মুসলিমসহ মারা যায় ৫৩ জন, আহত হয় দুইশোর বেশি।
সম্প্রতি, ভারতের স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের হিজাবকে কেন্দ্র করেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
অধিকারকর্মী শবনম হাশমি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, "মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষের বিস্তারই হিন্দুত্ববাদের দিকে নিয়ে যায়,"
"ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক উক্তি বেড়েই যাচ্ছে। অনেক ডানপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদী নেতারা মুসলিম গণহত্যার ডাকও দিয়েছেন, সরকার এতে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি," বলেন তিনি।
হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ কতোটা সম্পর্কিত?
১৯২৮ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক বিনায়ক দামোদর সাভারকর হিন্দুত্ববাদ নামক রাজনৈতিক ধারণাটির প্রবর্তন করেন, 'হিন্দুত্ববাদ: কে হিন্দু?' শিরোনামের পুস্তিকায় এই প্রস্তাব রাখা হয়।
কংগ্রেস আইনপ্রণেতা শশী থারুর সম্প্রতি এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছেন, "বেদ, পুরাণসহ হিন্দুধর্মের অনেকগুলি গ্রন্থ আছে, যেখানে হিন্দুত্ববাদের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পুস্তিকা মাত্র একটি।"
বিজেপি বলছে হিন্দুত্ববাদ হচ্ছে সামাজিক উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম।
সম্প্রতি বিজেপির এক সমাবেশে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বলেছেন, "হিন্দুত্ববাদ এবং উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। যারা হিন্দুত্ববাদের বিরোধীতা করছে তারা আসলে উন্নয়ন ও ভারতীয়ত্বের বিরোধিতা করছে।"
হিন্দুত্ববাদ 'বিভাজন সৃষ্টি করে না'
তবে দক্ষিণ কেরালা রাজ্যের বিজেপির একজন খ্রিস্টান সদস্য টম ভাদাক্কান বলেছেন, হিন্দুত্ববাদে বহুত্ববাদের জায়গা আছে।
তিনি ডয়েচে ভেলে-কে বলেন, "হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদ নিয়ে কোনো বিভাজন হওয়া উচিৎ নয়। দুটি বিষয় সম্পর্কিত, এবং একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা যা সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা একটি বহুত্ববাদী সমাজে বাস করি, কোনো সম্প্রদায়ের ওপর দলের আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা নেই।"
তিনি আরও বলেন, "হিন্দুত্ববাদ মানে বিভাজনের রাজনীতি নয়"।
মোদি সরকারের সংখ্যালঘু অধিকার মন্ত্রী মুসলিম বিজেপি সদস্য মুখতার আব্বাস নকভি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তার দাবি, হিন্দুত্ববাদ ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং এটি ভারতীয় সভ্যতার সংস্কৃতি-কৃষ্টির পুনঃজাগরণ।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে হিন্দুত্ববাদ নিয়ে এক উত্তেজনাময় টেলিভিশন বিতর্কের সময় নকভি বলেছিলেন, "হিন্দুত্ববাদের মধ্যেও আমরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা বলতে পারি,"
বিজেপির একজন মুখপাত্র শাজিয়া ইলমি ডিডব্লিউ-কে বলেছেন, গণমাধ্যম দ্বারা হিন্দুত্ববাদের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বিজেপি মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করে এ কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এই রাজনৈতিক আদর্শের অধীনে যে সামাজিক উন্নয়ন হয় তা ভারতের সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক।
২০১৯ সালের শেষ থেকে ২০২০ সালের শুরুর দিকে পুরো ভারত জুড়ে ১৭টি ভাষায় পরিচালিত প্রায় ৩০ হাজার প্রাপ্তবয়স্কদের মুখোমুখি সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি সমীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, সব ধর্মীয় বিশ্বাসের ভারতীয়রা জোর দিয়ে বলেছেন, তারা তাদের ধর্ম চর্চা করতে স্বাধীন।
বিজেপির একজন আইনপ্রণেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী কে জে আলফোনস ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক বিবাদের জন্য হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উপর দোষ দেওয়া উচিত নয়।
"আমরা প্রায় ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার একটি বিশাল দেশ। এসব ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর কারণ অর্থনৈতিক, ধর্মীয় নয়। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ষড়যন্ত্র খোঁজা অন্যায়," বলেন তিনি।
- সূত্র: ডয়চে ভেলে