কে হবে নয়া পরাশক্তি? ইউক্রেন সংকট ঘিরে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সেই প্রতিযোগিতার প্রকাশ ঘটছে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার দুঃসাহসী অভিযান। একবিংশ শতকে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি প্রথম বড় আঘাত এ যুদ্ধ, যাকে ঘিরে বিশ্বের প্রধান তিন শক্তির মধ্যে সেরার আসন দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এতে হুমকির মুখেই পড়েছে আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) আধিপত্য।
স্নায়ুযুদ্ধকালে আমেরিকা ও তার মিত্ররা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোও তা থেকে অনেকটাই আলাদা। বর্তমানে আমেরিকার শক্তি খর্ব করতেই সম্পর্কের বন্ধন জোরদার করে চলেছে চীন ও রাশিয়া।
১৯৫০ এর দশকে সিনো-সোভিয়েত জোটবন্ধনের কথাই ধরুন। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ নেই, চীনও বদলেছে। পুতিনের রাশিয়া সোভিয়েত অতীতের ঝাণ্ডাধারী হলেও একইসাথে ইউরোপে বড় গ্যাস সরবরাহকারী। অন্যদিকে, চীনও আজ সেকালের মতো দরিদ্র- যুদ্ধবিধ্বস্ত অংশীদার নয়। বরং বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র, দেশটির সমর শক্তিও বাড়ছে নাটকীয় হারে।
ইউক্রেন সীমান্ত কয়েক মাস ধরেই বিপুল বাহিনী মোতায়েন করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আর গেল বৃহস্পতিবার তার ভাষায় ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' পরিচালনার নির্দেশ দানকালে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের নিরাপত্তা চুক্তিগুলো নতুন করে লেখার দাবি জানান।
পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতা আর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজ ইচ্ছেকে বাস্তবায়নের সামরিক সক্ষমতা যে মস্কোর রয়েছে— সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন পুতিন।
চীন রাশিয়ার বৃহত্তম প্রতিবেশী। দুই দেশের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২০৯ কিলোমিটার সীমান্ত। ইউক্রেনে হামলা চালাতে চীন সীমান্ত থেকে রুশ সেনাবাহিনীর অনেক ইউনিট সরিয়ে এনেছে ক্রেমলিন। এর মাধ্যমে বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কে আস্থা থাকারই প্রমাণ দিয়েছেন পুতিন।
আনুষ্ঠানিক কোনো জোটবদ্ধ না হয়েও প্রকৃতপক্ষে এ দুই শক্তিধর রাষ্ট্র বিশ্ব ব্যবস্থাকে তাদের নিজেদের সুবিধেমতো ঢেলে সাজাতে একযোগে কাজ করে চলেছে।
উদীয়মান এ ব্যবস্থার ফলে আমেরিকাকে একসাথে ভূ-রাজনৈতিকভাবে দুই বৈরী প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব অঞ্চলে আবার আমেরিকার রয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্র (যেমন তাইওয়ান) অথবা সুগভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ।
উপর্যুপরি চ্যালেঞ্জের মুখে পররাষ্ট্রনীতিতে এখন কোন বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়া উচিত- তা নিয়ে বেশ কিছু বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। যার মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সামরিক ব্যয় আরো বৃদ্ধি, মিত্রদের ওপর আরো সামরিক ব্যয়ভার বহনের দাবি জানানো, বিদেশের মাটিতে মোতায়েন করা সামরিক শক্তি বৃদ্ধিসহ মস্কোর ওপর ইউরোপের জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে আমেরিকার নিজস্ব সরবরাহ বৃদ্ধির মতো বহুমুখী বিষয়।
মস্কো-বেইজিং সম্পর্ক তলে তলে বহুদূর যাবে আমেরিকা আন্দাজ করলেও, ইউক্রেন সংকটের পর তা ওয়াশিংটনকে বিস্মিত করেছে। এমনটাই জানান সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে পেন্টাগনের শীর্ষ নীতি-নির্ধারক কর্মকর্তা মিশেল ফ্লোরনোয়।
তিনি বলেন, "রাশিয়া গোপন অভিযান চালাবে আমাদের জানাই ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, কেজিবির পুরোনো কৌশলে পুতিন ইউক্রেনে অস্থিতিশীলতা বজায় রাখবেন। কিন্তু তিনি একটি স্বাধীন দেশের সরকার বদলাতে পুরোদমে সামরিক আগ্রাসন চালাবেন তা ভাবেননি অধিকাংশেই।"
মিশেল ফ্লোরনোয় আরো বলেন, "আমরা লক্ষ্য করছি বেইজিং রাশিয়ার কৌশল পছন্দ না করলেও, বিরোধিতাও করছে না। বরং দুই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে। আগামীতে আমরা তাদের এমন মিত্রতা আরও দেখতে পাব।"
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
স্নায়ুযুদ্ধ শেষে ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারকরা যেসব পদক্ষেপ নেন- সেসবই আজকের আমেরিকাকে 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' দশায় ফেলেছে। ওই সময়ে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রসারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপেও ন্যাটো জোট সম্প্রসারণ করে। এককালের ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত ওয়ারশ প্যাক্টের সাবেক সদস্য দেশগুলোকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হয়। মস্কোর নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর আকুতিকেই প্রাধান্য দেয় ওয়াশিংটন। ক্রেমলিনের অসন্তোষকে তখন গুরুত্ব দেয়নি।
এ বাস্তবতায় পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে ফাঁপা বুলির মাধ্যমে বিরোধিতাকে অসাড় হিসেবেই দেখেছেন পুতিন। তিনি নতুন ছক কষতে থাকেন, যেখানে রাশিয়া আবার সোভিয়েত যুগের আধিপত্য ফিরে পাবে। থাকবে নিজ প্রভাব বলয়ের দেশগুলোর ওপর একচ্ছত্র অধিকার।
ওদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে চীনের সমাজতান্ত্রিক দল। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোয় গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকে বেইজিং দেখেছে মার্কিন গুপ্তচরদের প্রকৌশলের ফসল হিসেবে।
তারই প্রতিক্রিয়ায়, নিজ দেশের জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে। বাড়িয়ে চলে সামরিক শক্তি। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর এই ধারাবাহিকতা কেবল নতুন উচ্চতা লাভ করে মাত্র।
হুমকি হিসেবে দেখার কারণেই হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকে কঠোরহস্তে দমনের নির্দেশ দেন গণচীনের প্রেসিডেন্ট।
আমেরিকা কিছু লক্ষ করেনি- এমন দাবি অহেতুক । বরং উল্টোটাই সত্য। ২০১৫ সালে পেন্টাগন 'পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আবার উদয় হওয়া'র পূর্বাভাস দেয়। তখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণপশ্চিম এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দূরপ্রাচ্যে নিয়োজিত করে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর।
ভবিষ্যতের যুদ্ধ-সংঘাতে এগিয়ে থাকার তাড়না থেকেই চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতি নেয় আমেরিকা। যেমন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন চীনকে 'ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ' বলেন। অন্যদিকে রাশিয়াকে দীর্ঘমেয়াদে তুলনামূলক কম বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
একথা তিনি বলেছেন ইউক্রেন সংকটের আগে। পেন্টাগনের সিংহভাগ কর্মকর্তাও এমন বিশ্লেষণে হয়তো বিশ্বাসী ছিলেন।
পেন্টাগনের ২০১৫ সালের প্রক্ষেপণ নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার নীতির সাথে মিলে যায়। বাইডেন অবশ্য দায়িত্বগ্রহণ করেই পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানোর সুযোগ পাননি। তার প্রশাসনকে প্রথমে মহামারি মোকাবিলা, অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনাসহ অনেক দেশজ ইস্যু ব্যস্ত থাকতে হয়।
তাছাড়া, বাইডেন ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যয়বহুল যুদ্ধের পর মার্কিন জনতাকে গঠনমূলক পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতিও দেন বাইডেন। যে নীতি মার্কিন জনতাকে স্পষ্ট লাভবান করবে।
বাইডেন ভেবেছিলেন, মস্কোর সাথে সম্পর্ক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেইজিংয়ের সাথে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করা যাবে।
পুতিনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে গেল বছরের জুনে তার সাথে এক যৌথ সম্মেলনে যোগ দেন বাইডেন। হোয়াইট হাউস জানায়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে একটি 'স্থিতিশীল ও অনুমেয়' সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চান।
মস্কোর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি (স্টার্ট) এর মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়াতে রাজিও হন বাইডেন। এমনকি আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের দমনে মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিগুলো করা যায় কিনা- পেন্টাগনকে মস্কোর সাথে সে আলোচনার করতেও নির্দেশ দেন।
সব দেখেশুনে পুতিন কী অলক্ষ্যেই হেসেছেন! হয়তো তাই।
পুতিন বিশ্বের অন্যখানে আমেরিকার মনোযোগ বুঝে বেলারুশ ও ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারই চূড়ান্ত পরিণতি হলো আমেরিকার ইউরোপিয় মিত্রদের দোরগোঁড়ায় বিপুল সেনা মোতায়েন এবং সবশেষে ইউক্রেন আক্রমণ।
এই বাস্তবতায় ৭০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়েও একইসাথে রাশিয়ার সৃষ্ট সংকট এবং চীনের হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে পেন্টাগনকে। তাছাড়া, চীন এখনও সর্বোচ্চ হুমকি হয়ে ওঠেনি। দেশটি যদি রাশিয়ার মতো করে তাইওয়ান বা অন্য প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করে বসে, তখন যুক্তরাষ্ট্রকে বিপাকে পড়তে হবে। কারণ, এখন ইউরোপের মিত্ররা চাইছে সেখানে মার্কিন সামরিক শক্তিবৃদ্ধি। লিথুনিয়া, লাটভিয়ার মতো সাবেক সোভিয়েত দেশ ইউক্রেনের পরিণতি চায় না। আর তাদের অনুরোধ রক্ষা না করলে পরাশক্তি আমেরিকারই নাক কাটা যাবে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কৌশলগত গবেষণা প্রকাশ করে মার্কিন কংগ্রেস। সেখানে বলা হয়, "একইসঙ্গে দুই বা ততোধিক ফ্রন্টে লড়তে হলে- যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।" ওই গবেষণায় জড়িত একজন কর্মকর্তা হচ্ছেন বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাথলিন হিকস।
ইতোমধ্যেই ইউক্রেন সংকটের কারণে ইউরোপে সেনা মোতায়েন করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। অচিরেই হয়তো প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সামরিক বাহিনীর আকার নিয়েও। এবার হয়তো পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণ যুগেরও অবসান হলো। কারণ রাশিয়ার হাতে আছে বিপুল পরমাণু অস্ত্র, কোনো চুক্তির অধীন না থাকায় দিনকে দিন চীনও বাড়িয়ে চলেছে তাদের অস্ত্রভাণ্ডার। তাই মার্কিন সেনাবাহিনী মনে করছে, এই দুই বিরোধীপক্ষকে ঠেকানোর জন্য বিপুল পরিমাণে পরমাণু অস্ত্র তাদের হাতেও রাখতে হবে।
এভাবেই বিশ্ব পা রাখছে আরো অনিশ্চিত, অনিরাপদ এক ভবিষ্যতের দিকে। যেখানে স্নায়ুযুদ্ধ ফিরে আসা আর কাল্পনিক নয়; বরং প্রকট বাস্তবতা।
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল