ইমরান খান কি অসাংবিধানিক কাজ করেছেন, তার কি শাস্তি হবে?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটির কথা ছিল জাতীয় পরিষদের নিম্নকক্ষে। কিন্তু, 'বিদেশি শক্তি সমর্থিত' এ প্রস্তাবে ভোটাভুটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫–এর বিরোধী উল্লেখ করে বাতিল করেন ডেপুটি স্পিকার কাশিম সুরি। এর পরই প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির কাছে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া ও তিন মাস পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেন ইমরান। প্রেসিডেন্ট সেটি বাস্তবায়নও করেন।
"সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫–এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা। সংবিধান ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে বাধ্যতামূলক, তিনি যেখানেই থাকুন কেন এবং পাকিস্তানে অবস্থান করার সময় প্রত্যেকের জন্যই তা প্রযোজ্য।"
জাতীয় পরিষদের নিম্নকক্ষে মোট আসন সংখ্যা ৩৪২, পাসের জন্য ১৭২ ভোটের প্রয়োজন হলেও অনাস্থা প্রস্তাবে ছিল ১৭৪ আইনপ্রণেতার সমর্থন। কিন্তু, এটি বাতিল করায় ভেস্তে যায় ইমরানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চেষ্টা। এতে ইমরান খান নিজেই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে।
জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে এরমধ্যেই একটি সুয়োমোটো নোটিশ গ্রহণ করেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।
আইন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে এ নোটিশ আদালতে দায়ের করা হয় বলে জানিয়েছে পাকিস্তানী সংবাদমাধ্যম দুনিয়া নিউজ।
পাকিস্তানের আইনজ্ঞরাও সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর রোববারের (৩ এপ্রিল) রাজনৈতিক চালের বিশ্লেষণ করেছেন।
দেশটির বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ সরুপ ইজাজের পর্যবেক্ষণ জানতে চায় দেশটির গণমাধ্যম জিও টিভি। সরুপ বলেছেন, প্রিমা ফ্যাসি বা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মনে হয়, (ইমরানের) অপরাধ অবশ্যই হয়েছে। তার চতুর কৌশল সংবিধানের লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট বাধাদান।
"যখন পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন অ্যাটর্নি জেনারেল খোদ আদালতকে নিশ্চিত করেন ভোটাভুটি হবে। তারপর বাতিলের ঘটনাকে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনই বলব"- ব্যাখ্যা করেন তিনি।
ইজাজ জানান, বর্তমানে আইনি এ বিরোধ সমাধানের একমাত্র কর্তৃপক্ষ হলেন মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট।
"অসাধু উদ্দেশ্যে (মালা ফাইড ইন্টেট) এবং কোনো অধিকার ছাড়াই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভঙ্গ হলে, পাকিস্তানের আদালতগুলো তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। আদালত যদি এটি অসাধু উদ্দেশ্যে নেওয়া পদক্ষেপ বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হন- তাহলে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকে অবৈধ ঘোষণা করা যাবে, কারণ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই অনাস্থা প্রস্তাবটি আনা হয়েছিল।
এই আইনজীবী আরও বলেন, আদালত ডেপুটি স্পিকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিলে, অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি করা যাবে।
ইজাজ জিও টিভিকে আরও বলেন, "আমার মতে, আদালত অবশ্যই হস্তক্ষেপের অধিকার রাখে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় আদালত তা উল্লেখও করেছেন। তবে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আদালতগুলো সংযত। তার মানে এই নয় যে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার ইচ্ছেমতো সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবেন।"
দ্য ডনকে আইনজীবী সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ডেপুটি স্পিকারের কর্মকাণ্ড শুধু অবৈধ নয় বরং তা স্পষ্ট অসাধু উদ্দেশ্য (মালা ফাইড)।
সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী মাত্র দু মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, তারপর স্পিকার একক সিদ্ধান্তে অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিকে অবৈধ উল্লেখ করে অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করেছেন।
তার মতে, কোনো প্রস্তাব বা আইন পাসের ব্যাপারে সরাসরি বাধাদানের ক্ষমতা স্পিকারদের হাতে নেই। স্পিকারের দায়িত্ব অধিবেশনে কে কে উপস্থিত আছেন সে হিসাব করা, কোনো প্রস্তাব পাস হলো না ব্যর্থ হলো তা ঘোষণা করা, পরিষদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু, তিনি নিজ ক্ষমতার বাইরে পা রেখেছেন।
"এ বাস্তবতায় আদালতের কাছে কেবল হস্তক্ষেপের অধিকার রয়েছে শুধু তাই নয়, বরং অবশ্যই আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত। খুব সম্ভব সুপ্রিম কোর্ট স্পিকারের ঘোষণাকে অবৈধ সাব্যস্ত করবেন। তারই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।"
আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ইমরানের সামনে চ্যালেঞ্জ এখনো ফুরায়নি। এবার তাকে আদালতে লড়তে হবে। দিতে হবে, তিনি ও তার সহযোগীদের কর্মকাণ্ডের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। আদালত যদি, অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির রায় দেন- তাহলে প্রধানমন্ত্রীত্বও হারাবেন তিনি। সাবেক ক্রিকেটার হয়েও পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন কি 'ফেয়ার প্লে'র চিরায়ত নীতিকেই লঙ্ঘন করলেন?- উত্তর হয়তো জানা যাবে খুব শিগগিরই।
- সূত্র: দ্য ডন, জিও টিভি