কেমন হবে ইউক্রেনে রাশিয়ার পরবর্তী আক্রমণ কৌশল
রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার দেড় মাস পেরিয়েছে। যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু এখন সরে গেছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে। রুশ বাহিনী এখন কিয়েভ দখলের চেয়ে দেশটির পূর্বাঞ্চলের দনবাস অঞ্চল দখলের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বেশি।
তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেনের সেরা ইউনিটগুলো মোতায়েন রয়েছে পূর্বাঞ্চলে।
এ পর্যন্ত রুশ বাহিনীকে শক্তভাবেই প্রতিরোধ করেছে ইউক্রেনিয়ান বাহিনী। তবে সামনে সংখ্যায় এগিয়ে থাকা রুশ বাহিনীর কাছে তাদের হার মেনে নিতে হতে পারে।
কোথায় হবে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলো?
রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের সেনাবহরের বর্তমান মনোযোগ পুরোটাই কেন্দ্রীভূত দনবাসকে (ইউক্রেনের পূর্ব দিকের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চল) 'সম্পূর্ণ মুক্ত' করার ওপর।
পূর্ব দিকের এই অঞ্চল জয় করা রাশিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্মুক্ত অঞ্চলের যুদ্ধের ইউক্রেনিয়ান বাহিনী খানিকটা বাড়তি সুবিধা পেতে পারে।
ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলছে, এর পরেই গুরুত্বের দিক থেকে সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে স্লোভিয়ানস্কের যুদ্ধ।
ইজিয়াম থেকে অগ্রসরমান রুশ বাহিনী যদি শহরটির দখল নিতে পারে, তাহলে তারা দুটো সুবিধা পাবে। এক, পুবে রুবিঝনি-র দিকে এগিয়ে গিয়ে ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর তুলনামূলক ছোট দলকে ঘিরে ফেলতে পারবে। দুই, দক্ষিণে আরও এগিয়ে গিয়ে ইউক্রেনের বাহিনীর আরও বড় একটি অংশকে ঘিরে ফেলতে পারবে।
রাশিয়ানরা যদি মারিউপোলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তাহলে দোনেৎস্কের পশ্চিম অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে রুশ বাহিনী।
কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছে ইউক্রেনিয়ানরা?
ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) বেন ব্যারি বলছেন, ইউক্রেনিয়ান বাহিনী বহু বছর ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তাই তাদের পরাস্ত করতে রুশ বাহিনীকে বেগ পেতে হতে পারে।
সাঁজোয়া যান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনিয়ানরা পাথরের আবরণ দেয়ালে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া পূর্বাঞ্চলের অনেক ইউক্রেনিয়ান বহরই অত্যন্ত অভিজ্ঞ। ২০১৪ সালের সংঘর্ষের সময় থেকে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠেকাচ্ছে তারা।
উত্তরাঞ্চল থেকে রুশ বাহিনী সরে এলে কিয়েভকে রক্ষার জন্য আর তেমন বেশি সৈন্যের দরকার হবে না। তখন পূর্বাঞ্চলে আরও বেশি সেনা পাঠাতে পারবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী।
রাশিয়া কীভাবে আক্রমণ করবে?
ব্রিগেডিয়ার ব্যারি বলছেন, রাশিয়া সম্ভবত প্রথমে প্রচণ্ড বিমান হামলা চালাবে। ইউক্রেনিয়ানদের প্রতিরোধ ভাঙার জন্য ভারী গোলাবর্ষণ করতে পারে রুশ বাহিনী।
প্রথমে আকাশপথে ভারী বোমাবর্ষণ না করে পদাতিক বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলে প্রচুর রুশ সেনা হতাহত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।
ব্রিগেডিয়ার ব্যারির মতে, বেশ রক্তক্ষয়ী লড়াই হতে পারে দুপক্ষের মধ্যে।
অনেক দূর থেকে ইউক্রেনিয়ানদের অবস্থান নষ্ট করার জন্য রাশিয়ার হাতে বেশ কিছু রকেট লঞ্চার সিস্টেম আছে। রুশ বাহিনীর সেসব রকেট ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়ার কাছে ৪০টি রকেট আছে, যেগুলো ২০ সেকেন্ডের মধ্যে উৎক্ষেপণ করা যায়। এসব রকেট উৎক্ষেপণ করলে বেসামরিক এলাকাও ধ্বংস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া জানা গেছে, মারিউপোল ও খারকিভসহ ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে থার্মোবারিক বোমাও ব্যবহার করেছে রুশ বাহিনী। থার্মোবারিক বোমা প্রথাগত বোমার চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী।
থার্মোবারিক বোমা বিশেষভাবে শহুরে যুদ্ধের জন্য বানানো। কেননা এই বোমা এমনভাবে বিস্ফোরিত হয় যে এ থেকে নিঃসৃত জ্বালানি বিভিন্ন ভবনের ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়তে পারে।
যাহোক, রুশ বাহিনী যদি ইউক্রেনের প্রধান প্রতিরোধব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারে, তাহলে রাশিয়া সম্ভবত পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করবে। তাদের সঙ্গে থাকবে ছোট ছোট অস্ত্র ও ট্যাঙ্কসহ কয়েক ধরনের চাকাওয়ালা যান।
আকাশপথে হামলার প্রধান অস্ত্র হতে পারে ফাইটার বম্বার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছেন, এ যুদ্ধ 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেবে।'
রাশিয়া কোথায় ঝামেলায় পড়তে পারে?
ইউক্রেনে হামলা শুরুর প্রথম সপ্তাহে গুরুতর লজিস্টিক সমস্যা ছিল রুশ বাহিনীর। সে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে কি না, তা এখনও বুঝতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
রুশ বাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত জ্বালানি, খাবার, পানি এবং রেডিও ও ঠান্ডা আবহাওয়ার উপযোগী কাপড়ের মতো মৌলিক সরঞ্জামাদি ছিল না।
ব্রিগেডিয়ার ব্যারি বলেন, 'প্রশিক্ষণ, মনোবল ও নেতৃত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিয়েভের আশপাশে রাশিয়ানদের পারফরম্যান্স অত ভালো ছিল না। তা থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে কি না, তা-ও আমরা জানি না।'
এছাড়া রাশিয়া ইউক্রেনের চেয়ে তিন গুণের বেশি সেনা হারিয়েছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে।
পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধের ওপর এসবের প্রভাব কেমন হবে, তা বলা মুশকিল। তবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সরঞ্জামাদির অভাব পূরণ করাটা গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে।
সামরিক সরঞ্জামাদি ধ্বংস বা নষ্ট হওয়ার হিসাব রাখে ওপেন সোর্স সামরিক বিশ্লেষণ ওয়েবসাইট ওরিক্স। যেসব ধ্বংস হয়ে যাওয়া যান বা সরঞ্জামাদির ছবি বা ভিডিও পাওয়া যায়, কেবল সেগুলোকেই হিসাবে আনে ওয়েবসাইটটি।
ওরিক্সের হিসাবে, রাশিয়া আনুমানিক ৪০০-র বেশি ট্যাঙ্ক, ২০টি এয়ারক্রাফট ও ৩২টি হেলিকপ্টার এবং কয়েকশো সাঁজোয়া যান ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি হারিয়েছে এ পর্যন্ত।
এছাড়া ইউক্রেন বেশ ভালো পরিমাণে রুশ সরঞ্জামাদি দখল করেছে। তবে সেগুলো তারা কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়।
তবে চলমান লড়াই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে এগোলে—এবং ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহে বাধা দিতে পারলে—শেষতক এ যুদ্ধের পাল্লা রাশিয়ার দিকেই হেলে পড়বে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
- সূত্র: বিবিসি