কে এই জেনারেল দভরনিকভ? ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার নতুন কমান্ডার
"দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন থেকেই তার কপালে 'কসাই' খেতাব জুড়ে যায়। এরপর সিরিয়ার আলেপ্পোতে হামলার সময়ও 'কসাই' হিসেবেই তাকে চিনত লোকে," রাশিয়ান জেনারেল আলেকজান্দার দভরনিকভকে নিয়ে এমনটাই মন্তব্য করেছেন ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইহর রোমানেনকো।
সম্প্রতি ইউক্রেনে থাকা রাশিয়ান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েছেন দভরনিকভ। ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে তার নেতৃত্বেই রাশিয়ান মটর রাইফেল ডিভিশনই চেচনিয়ার রাজধানী গ্রজনিতে হামলা চালিয়েছিল।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় তার বাহিনী শহরের সাধারণ নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করেছিল। সেই যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর নিক্ষিপ্ত রকেট আর্টিলারি, নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা, ও ক্রুজ মিসাইল-এর আঘাতে গ্রজনির কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। পুরো শহরটি পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
২০০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ানদের হাতে গ্রজনির পতন ঘটে। তা-তে নির্বাচনে জেতা সহজ হয়ে যায় পুতিনের জন্য। বর্তমানে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মারিওপোলের ক্ষেত্রেও রাশিয়া একই রণকৌশল অবলম্বন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, রাশিয়ান বাহিনী ইতোমধ্যে কয়েক হাজার সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছে এবং শহরের প্রায় প্রতিটা ভবনে নিজেদের হামলার নিদর্শন রেখেছে।
দভরনিকভ'র আলেপ্পোর যুদ্ধ
২০১৫ সালে সিরিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীর দায়িত্ব দভরনিকভের হাতে তুলে দেন ভ্লাদিমির পুতিন।
দায়িত্ব পেয়ে সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের গদি রক্ষা করেন দভরনিকভ। পরে বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি আলেপ্পোর দখল নিতেও সমর্থ হন তিনি।
আলেপ্পোতেও গ্রজনির যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করেছিলেন দভরনিকভ। সে সময় রাশিয়ান হামলায় সিরিয়ার কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ঐতিহাসিক আলেপ্পো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
ইউক্রেনিয়ান লে. জেনারেল রোমানেনকো বলেন, 'তার পথে কোনো কিছুই বাঁধা হয়ে উঠতে পারে না। তিনি পুরনো সোভিয়েত কৌশল ও রাশিয়ান কৌশল দুটোই ব্যবহার করেন।'
'আলেপ্পোর ফলাফল আমরা দেখেছি,' বলেন রোমানেনকো।
কিন্তু সেই ফলাফলকে ভিন্নভাবে দেখেছিলেন দভরনিকভ।
২০১৬ সালে মার্চ মাসে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত রসিসকায়া গ্যাজেটা-কে দেওয়া বিরল এক সাক্ষাৎকারে দভরনিকভ বলেছিলেন, 'রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক পদক্ষেপের কারণে সাড়ে পাঁচ মাসে সিরিয়ার পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। এতে সিরিয়ার ভেঙে পড়া রোধ করা গিয়েছিল।'
ক্রেমলিনে দভরনিকভের গলায় রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ সামরিক মর্যাদাগুলোর একটি 'হিরো অব রাশিয়া' মেডেল তুলে দিয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন।
তবে আপাতত দভরনিকভের পুরনো কৌশল ইউক্রেনে কাজে লাগছে না বলে দাবি করেছে আল জাজিরা।
ইউক্রেনের জঙ্গুলে ভূমিরূপ, ইউক্রেন বাহিনীর প্রত্যাঘাত, রাশিয়ানদের স্বল্প লজিস্টিকস ও মনোবল ইত্যাদি কারণে কিয়েভের দিকে রাশিয়ার অগ্রসর বারবার থমকে গিয়েছিল বলে মনে করেন রোমানেনকো।
এ যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর যথেষ্ঠ শক্তিক্ষয় হয়েছে। এপ্রিল মাসেই কিয়েভ, চেরনিহিভ, ও সুমি অঞ্চল থেকে পিছু হটেছে রাশিয়ানরা।
রোমানেনেকো জানান, 'দক্ষিণ ইউক্রেন মোটামুটি সমতল, তাও এখানেও একই রণকৌশল ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে রাশিয়াকে।'
বিদ্রোহীদের সমর্থন
২০১৪ সালে দনেৎস্ক ও লুহানস্ক-এ ক্রেমলিনের সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। এর দুই বছর পরে পুতিন রাশিয়ার সাউদার্ন মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট-এর নেতৃত্ব দভরনিকভের কাঁধে তুলে দেন।
সে দায়িত্বের মাধ্যমে দখলিকৃত ক্রিমিয়া, এবং দক্ষিণ ওশেটিয়া ও আবখাজিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোর দায়িত্বও দভরনিকভের ওপর বর্তায়।
সে সময় ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর কথা মস্কো তীব্রভাবে প্রত্যাখান করলেও কিয়েভের কর্মকর্তা, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা, ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায় ওসব বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও 'পরামর্শকে'রা উপস্থিত ছিলেন।
এ যুদ্ধ ইউরোপের সবেচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধে পরিণত হয়, মারা যায় ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধের কারণে কয়েক লাখ ইউক্রেনিয়ান বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সাউদার্ন মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট-এর দায়িত্ব পাওয়ার পর ইউক্রেন নিয়ে বিস্তর ধারণা লাভ করেন দভরনিকভ। এরপর তিনি এইটথ গার্ডস কম্বাইন্ড আর্মি তৈরি করেন। রাশিয়ান মিলিটারির শাখাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছিল, সেটিকেই পুনর্জীবিত করেন এ দুঁদে জেনারেল।
২০১৯ সালে আজভ সাগরে রাশিয়ান নৌবাহিনীর জাহাজ ইউক্রেন নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ আটকে দেয়। এরপর সেই জাহাজগুলোর ২৪ জন ইউক্রেনিয়ান নাবিককে আটক করে রাশিয়া। তাদরকে ১০ মাস রাশিয়ায় আটক রাখা হয়। এ ঘটনার পেছনে দভরনিকভের হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
এ ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৯ সালে দভরনিকভসহ আরও সাতজন রাশিয়ান জেনারেল ও কর্মকর্তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
ওই সময়ই বেশ কয়েকটি বৃহৎ পরিসরের সামরিক মহড়ার সফল পরিচালনা করেন দভরনিকভ।
২০২০ সালে বিশাল ককেসাশ সামরিক মহড়ার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল দভরনিকভ। ওই মহড়ায় রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর অযুত পরিমাণ সেনা অংশ নেয়।
সেই মহড়ায় 'মোবাইল ইশেলনস' নামে ভূমি, আকাশ, ও নৌপথে সেনা সমন্বয় করার নতুন একটি পদ্ধতি প্রদর্শন করা হয়।
রাশিয়া, ক্রিমিয়া, ও আর্মেনিয়ার ৩০টি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত ওই অতিকায় মহড়া দেখতে গিয়েছিলেন পুতিনও। তাকে তখন দভরনিকভ নিশ্চিত করেছিলেন 'রাশিয়ান সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত'।
ওই সামরিক মহড়াটিকে ভবিষ্যতে ইউক্রেন আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে অভিহিত করে তখনই সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছিল ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
দভরনিকভ ও ইউক্রেন যুদ্ধ
এরপর ২০২১ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দভরনিকভের মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ইউক্রেনের সীমান্তের পাশে, বেলারুশে, ও ক্রিমিয়াতে সেনা সমাবেশ শুরু করে রাশিয়া।
তারপর জল অনেকদূর গড়ায়। ইউক্রেন, ন্যাটো ইত্যাদি বিষয়ে রাশিয়ার লিখিত দাবি প্রত্যাখান করে ইউক্রেন ও পশ্চিমা শক্তি।
তারপর কিয়েভের সরকারকে সরানো ও দেশটিকে 'নাৎসিমুক্ত' করার জন্য ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া।
প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে এ যুদ্ধ চলছে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের তথ্যমতে, এ যুদ্ধে সোমবার (১১ এপ্রিল) পর্যন্ত কোনো কমান্ডারের নাম ঘোষণা করেনি রাশিয়া।
সোমবার আলেকজান্দার দভরনিকভকে ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণের কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে এ জেনারেল দনবাস ও দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে কেউ মনে করছেন, ফ্রন্টলাইনে থাকা সশস্ত্র বাহিনীকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে মুক্ত হতেই পোড়-খাওয়া দভরনিকভের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়েছে রাশিয়া।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সমস্যা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে নয়। তারা বলছেন, রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ অফিসারেরা লম্বা সময় ধরেই এমন কোনো যুদ্ধে অংশ নেননি যেখানে পুরো জাতির সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি স্থানীয় কোনো 'বিশেষ অভিযান' (ইউক্রেন আক্রমণকে বিশেষ অভিযান হিসেবেই আখ্যা দিয়েছে রাশিয়া)-এও অংশ নেননি তারা।
ফলে এ বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, স্রেফ দভরনিকভকে দায়িত্ব দিলেই যুদ্ধে বড় কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
সূত্র: আল জাজিরা