দক্ষিণ কোরিয়ানদের বয়স কমে যেতে পারে এক বছর!
'আপনার বয়স কত?' সহজ এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তরই আশা করে সবাই। কিন্তু যাদের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ায়, তাদের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিছুটা কঠিনই বটে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে তখন তাদেরকে এক বছর বয়সী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপর ইংরেজি নববর্ষে, অর্থাৎ জানুয়ারির ১ তারিখে তাদের বয়সের সাথে আরও এক বছর যোগ হয়। এর অর্থ হলো, ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী বলে বিবেচিত হয় সেই দেশে!
তবে, শিগগিরই পরিবর্তিৎ হতে পারে 'কোরিয়ান এইজ' এর এই শতাব্দী প্রাচীন নিয়মটি। দেশটির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইউন সক-ইওল এই গণনা পদ্ধতি বাতিল করার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন।
প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ট্রানজিশন কমিটির প্রধান লি ইয়ং-হো বলেন, দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য বয়স গণনার পদ্ধতিকে নবায়ন করতে চাইছে আসন্ন প্রশাসন।
তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে বয়স গণনার ফলে 'বিভ্রান্তি' সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি 'অপ্রয়োজনীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক খরচ' করতে হয়।
এক প্রশ্নের তিন উত্তর
কোরিয়াতে একজন নাগরিকের বয়স গণনা করার তিনটি উপায় রয়েছে।
তবে, ১৯৬২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি বেশিরভাগ আইনি এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির জন্ম তারিখ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করছে।
কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে তাদের নিজস্ব কিছু সরকারি পদ্ধতি। এরমধ্যে একটি হলো, কোরিয়ান শিশুরা শূন্য বছর বয়সে জন্মগ্রহণ করে এবং প্রতি বছর জানুয়ারির ১ তারিখে তাদের বয়সের সাথে এক বছর যোগ হয়। এই পদ্ধতিতে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর বয়স ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগেই ২ বছর হবে।
এই পদ্ধতিটি মূলত আইনি বয়স সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত হয়। সামরিক পরিষেবাতে যোগদান বা কিশোরদের বয়স সংজ্ঞায়িত করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
আরও একটি পদ্ধতি হলো 'কোরিয়ান এইজ' পদ্ধতি, যা সাধারণত কোরিয়ান সমাজের সবাই ব্যবহার করে থাকে। এই নিয়ম অনুযায়ী, জন্মের সময়ই একটি শিশুর বয়স হয় ১ বছর, তারপর প্রতি ইংরেজি নববর্ষে তাদের বয়সের সাথে আরও এক বছর যোগ হয়।
এই পদ্ধতিগুলোর অধীনে, মেগা কে-পপ ব্যান্ড বিটিএস এর সদস্য কিম তে-হিয়ুং ওরফে ভি এর বয়স যথাক্রমে ২৮ বছর (কোরিয়ান এইজ পদ্ধতি), ২৬ বছর (আন্তর্জাতিক হিসাবে) এবং ২৭ বছর (কোরিয়ান অফিসিয়াল এইজের হিসাবে)। ১৯৯৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
অনেকের কাছে বয়স কেবল একটি সংখ্যা হলেও দক্ষিণ কোরিয়াতে বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়।
কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক শিন জি-ইয়াং বিবিসিকে বলেন, "দক্ষিণ কোরিয়ানদের কাছে সামাজিক প্রেক্ষাপটে কারও নাম খুঁজে বের করার চেয়ে কেউ তাদের থেকে বড় কি না তা খুঁজে বের করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যক্তিকে কীভাবে সম্বোধন করতে হবে এবং কী ধরনের সম্মানজনক উপাধি প্রয়োজন তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য।"
হানসাং ইউনিভার্সিটির আইন ও নীতি বিভাগের অধ্যাপক কিম ইউন-জু এর মতে, "বিশ্বায়ন কোরিয়ানদেরকে আন্তর্জাতিক বয়স সম্পর্কে আরও সচেতন করেছে। এটি প্রধানত তরুণদের উপর প্রভাব ফেলে কারণ তারা মনে করে যে এই গণনা পদ্ধতির জন্য কোরিয়ানদেরকে উপহাস করা হচ্ছে।"
কিন্তু উপহাস ছাড়াও, তিনটি ভিন্ন পদ্ধতি থাকায় তা দক্ষিণ কোরিয়ানদের উপর বাস্তবিকভাবেই প্রভাব ফেলেছে।
করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে কোরিয়ানদের বয়সকে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে হিসাব করার জন্যও আহ্বান জানানো হয়। ভ্যাকসিন নিবন্ধনের জন্য দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক বয়স এবং কোরিয়ান বয়স দুটিই ব্যবহার করায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় তখন।
এছাড়া, দেশটিতে অতিরিক্ত মজুরি ও অবসর গ্রহনের বয়সের হিসাব নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে একটি আইনি মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।
কোরিয়ানদের বয়স পরিমাপের ঐতিহ্যের উৎপত্তি মূলত চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন অংশে। তবে ধারণা করা হয়, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াই একমাত্র দেশ যা এখনও এইভাবে বয়স গণনা করে।
- সূত্র- বিবিসি