ডনবাসের রণাঙ্গনে আসলে কী ঘটছে? রুশ আক্রমণে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ইউক্রেনীয় সৈন্যরা!
শিল্প কারখানা, উর্বর কৃষিজমি আর বনসম্পদে সমৃদ্ধ ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল। এই অঞ্চলটি রুশ ভাশাভাষী অধ্যুষিত। কিয়েভের পশ্চিমাপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে এবং মস্কোর মদদে ২০১৪ সাল থেকেই এ অঞ্চলে চলে আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা।
ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ইউক্রেন সরকার ওই সময় থেকেই সেখানে সেনা উপস্থিতি বাড়ায়। এই ফ্রন্টে তাই মোতায়েন রয়েছে কিয়েভের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাদল, যাদের কাঁধে এখন রুশ সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্ব।
অবশ্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলার সাথে সরাসরি রুশ বাহিনীকে মোকাবিলার লড়াইকে তুলনা করা যায় না। আগে তাদের খণ্ড লড়াইয়ে অংশ নিতে হতো, চলতো থেকে থেকে গোলাগুলি বিনিময়– যা এখন পূর্ণযুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।
কিয়েভ অভিযানের ব্যর্থতার পর রাশিয়া এখন ডনবাস অঞ্চলটি পুরোপুরি দখলের অভিযান শুরু করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এ লড়াইয়ের নাম দিয়েছে 'ব্যাটল অব ডনবাস।' এতে জয়-পরাজয় সম্পূর্ণ ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণী হতে পারে।
রাশিয়া এমন উদ্দেশ্য থেকেই ডনবাস অভিযানের জন্য নতুন করে সেনা ও সমরাস্ত্র মোতায়েন বাড়িয়েছে। সর্বাত্মক এই আক্রমণের মুখে ইউক্রেনীয় সেনারা কতদূর লড়তে পারবে- তা নিয়ে খোদ পশ্চিমা গণমাধ্যমও সংশয় প্রকাশ করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সেজন্য ইউক্রেনকে দেওয়া সামরিক সহায়তা বাড়িয়েছে। তবু পরিস্থিতি প্রতিকূল সেদিকটিও স্পষ্ট।
ডনবাসে আট বছর ধরে মোতায়েন থাকা এমন এক ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তা হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট ডেনিস গর্ডিভ। লড়তে তিনি অভ্যস্ত হলেও এমন ভয়াবহ যুদ্ধ করতে হবে তা কল্পনাও করেননি। এমন কথা জানিয়ে তিনি বিবিসিকে বলেন, "আমাদের ওপর প্রতিদিন, প্রতিঘন্টায় বোমা ও রকেট হামলা হচ্ছে।"
রুশ বাহিনীর পূর্ণশক্তির মুখে ইউক্রেনীয়রা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।
রাশিয়া ইউক্রেনের অন্য অঞ্চল থেকে বহু সেনা ইউনিটকে সরিয়ে মোতায়েন করেছে ডনবাসে। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তাদের ধারণা, এ অঞ্চলে বর্তমানে ৭৬ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করেছে মস্কো। প্রতি ব্যাটালিয়নে আছে ন্যূনতম ৮০০ সেনাসদস্য।
তারা আরও জানিয়েছেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে যেসব সামরিক পরিকল্পনা ও কৌশলে ভুল করেছিল সেগুলো সংশোধন করছে। ডনবাসের লড়াইয়ে রাশিয়ার যুদ্ধ কৌশলে দেখা যাচ্ছে তারই প্রতিফলন। তাছাড়া, সম্পূর্ণ ইউক্রেন ছেড়ে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চল দখলে বেশি মনোযোগ দেওয়ায়, রুশ কমান্ডারদের ওপর চাপ কমেছে। তারা এখন অনেক সাবলীল সিদ্ধান্ত পারছেন। একেক কম্যান্ডের আওতায় আরও শানিত আক্রমণ চালাতে পারছেন শত্রুর বিরুদ্ধে।
ফলে ডনবাসের ৩০০ মাইল দীর্ঘ সম্মুখভাগে রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে বেশ অসুবিধায় পড়েছে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা। এরমধ্যেই তারা রুশ বাহিনীর কাছে অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং আগামীতে আরও হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তাছাড়া, ইউক্রেনীয় ফ্রন্টলাইনের দুর্বল স্থানগুলো চিহ্নিত করতে কৌশল নিচ্ছে রাশিয়া। ছোটখাট হামলা চালিয়ে বুঝে নিচ্ছে প্রতিরোধ কোথায় শক্তিশালী আর কোথায় শিথিল।
এখন পর্যন্ত উত্তরে ইঝিয়াম থেকে পূর্বে সেভেরদনেয়েস্ক ও পোপসানা পর্যন্ত দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। একসাথে আক্রমণ চালানো হচ্ছে অনেক দিক থেকে। তবে ইউক্রেনের জন্য আপাত সান্তনা রুশ বাহিনী এখনও বড় ধরনের কোনো অগ্রযাত্রা তারা ঠেকিয়ে রেখেছে।
ডেনিস গর্ডিভ নামের ওই লেফটেন্যান্ট জানান, তিনি ও তার অধীনস্থ ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর এ কৌশলের প্রভাব ভালোভাবেই পড়ছে। এরমধেই মারা গেছে তার এক সেনা, আহত আরও পাঁচজন। ইউক্রেনীয় বাহিনীতে প্রতিনিয়ত যে হতাহতের ঘটনা ঘটছে এটি তার তুলনায় সামান্য এক অংশ হলেও মনোবল ধরে রাখতে নিজস্ব হতাহতের সংখ্যা সেভাবে প্রকাশ করছে না ইউক্রেন সরকার।
রণাঙ্গনে অবস্থিত একটি ফিল্ড হসপিটাল পরিদর্শন করতের চেয়েছিল বিবিসির প্রতিবেদক টিম। কিন্তু, খুব ব্যস্ত থাকার কথা বলে এই অনুরোধ এড়ায় কর্তৃপক্ষ। তবে এ ঘটনা সেখানে অনেক আহত সৈনিক থাকার দিকেও ইঙ্গিত দেয়।
এমন অবস্থায় প্রশ্ন জাগছে, ডনবাসে রাশিয়া যে বিশাল আক্রমণ অভিযান শুরুর ধারণা করা হয়েছিল- সেটি কী পূর্ণদ্যমে চলছে? নাকি বর্তমান দশা তার আগেরই প্রস্তুতি? অর্থাৎ, রুশ বাহিনীর মূল অভিযান হয়তো আরও প্রচণ্ড হতে চলেছে আগামী দিনগুলোয়।
আসলেই কী চলছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বর্তমানে আগ্রাসী রুশ বাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের গোলন্দাজ ইউনিট ও রকেট ইউনিটের মাধ্যমে হামলার মাত্রা ও পরিধি বাড়িয়েছে। কিছু সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আসল যুদ্ধাভিযান এখনও তারা শুরু করেনি।
প্রতিকূল হলেও এখন লে. গর্ডিভ ও তার ইউনিট এখনও টিকে আছে, লড়াই চালিয়ে যেতে পারছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীও সম্মুখভাগ ধরে রাখতে পারছে। তবে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, এরমধ্যেই শত্রুর তুলনায় তাদের সংখ্যা বেশ কমে গেছে। বর্তমানে তিনজন রুশ সেনার মোকাবিলায় ডনবাসে লড়ছে মাত্র একজন ইউক্রেনীয় সেনা।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, এত সর্বাত্মক আক্রমণ ইউক্রেনীয় বাহিনী ঠেকাতে পারবে না। তাদেরকে খোলা জায়গাগুলোর প্রতিরোধ এক সময় বন্ধ করতে হবে, সীমিত শক্তি তারা শহরগুলোয় মোতায়েন করবে- যাতে সেগুলো রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। অর্থাৎ, ডনবাসের অনেক উন্মুক্ত অঞ্চল রাশিয়ার দখলে যাবে সে সত্যটি অনুধাবন করছেন তারা।
এই কৌশলই হয়তো কাজেও দেবে, কারণ এরমধ্যেই শহরাঞ্চলের যুদ্ধে রুশ বাহিনীর বেশকিছু দুর্বলতা উঠে এসেছে। কয়েকটি শহর দখল করতে তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও পড়েছে। তাছাড়া, আবাসিক এলাকায় যেকোনো আগ্রাসী বাহিনীর জন্য যুদ্ধ করাটাই তুলনামূলক কঠিন।
সংকট কালে ঈশ্বরের কাছে সাহায্য চাইছেন গর্ডিভ ও তার সেনারা। বিবিসি প্রতিবেদক লড়াইয়ের মাঝের এক বিরতিতে সেখানে গিয়ে তাদের তৈরি একটি প্রার্থনা বেদী দেখেছেন। সেনারা সেখানে নিহত সহকর্মীদের জন্য শান্তি ও যুদ্ধজয়ের প্রার্থণা করে।
বিবিসি প্রতিবেদক লিখেছেন, 'জায়গাটি এমন শান্তি কামনার জন্য বেশ বেমানান। কারণ, সেখানে দাঁড়িয়ে দূর থেকে মেঘগর্জনের মতো কামানের ধ্বনি শুনতে পারছিলাম।'
রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে খন্দক বা পরিক্ষা (ট্রেঞ্চ) খুঁড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। সেখানেই তারা অবস্থান নিয়েছে, লড়াই করছে আবার থাকছেও সেখানে।
ট্রেঞ্চের দিকে যেতে যেতে গর্ডিভ বিবিসি প্রতিবেদককে জানান, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মর্টারের গোলাবর্ষণ ও স্নাইপারের গুলি। তাদের অবস্থান থেকে মাত্র ৬০০ মিটার দূরেই আবার রুশ সেনারা অবস্থান করছে।
ডনবাসের এই সম্মুখভাগের বেশিরভাগ এলাকা উন্মুক্ত গ্রামীণ অঞ্চল। বনের আচ্ছাদন শত্রুর গোলাগুলি থেকে কিছুটা সুরক্ষা দেয়, কিন্তু সবখানে তেমন বনও নেই। ট্রেঞ্চের কাছাকাছি আসতেই থেমে থেকে হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিবর্ষণের আওয়াজও শোনেন বিবিসির সাংবাদিক।
লে. গর্ডিভ তাকে বলেন, "আমরা জানি রুশ সেনারা আসছে, ওরা ইউক্রেনের ভুখণ্ডে আসছে (দখল করতে)। কখন তাদের আসা বন্ধ হবে আমরা জানি না। তারা কতদূর যেতে চায় (দখলে নিতে চায়) তাও আমাদের জানা নেই।"
সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগে একজন আইনজীবী ছিলেন গর্ডিভ। তিনি একদিন নিজ পেশায় ফিরে যাওয়ার আশা পোষণ করেন। কিন্তু, যুদ্ধ কবে শেষ হবে; কবে তিনি সে সুযোগ পাবেন- তাও আন্দাজ করতে পারছেন না। আপাতত যুদ্ধ জয়ই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ট্রেঞ্চে অবস্থান করা অন্য সেনাদের মধ্যেও ক্লান্তি ও অবসাদের চিহ্ন দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে টানা লড়াই করে শ্রান্ত তাদের অনেকেই।
তবে সেনারা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে নিজেদের মনোবল অটুট থাকার দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। রকেট চালিত গ্রেনেড (আরপিজি), ডুশকা ভারী মেশিনগানসহ নানান সমরাস্ত্র দেখান। সোভিয়েত আমলের এসব অস্ত্রের সংখ্যাই বেশি তাদের কাছে, তবে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া অত্যাধুনিক এন-ল ট্যাংক বিধবংসী মিসাইলও তারা গর্বের সাথেই দেখিয়েছে।
এরকম সামান্য পরিমাণে কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র ছাড়া বর্তমানে তাদের হাতে রাশিয়ান বাহিনীকে মোকাবিলা করার মতো বা দীর্ঘদিন ঠেকিয়ে রাখার মতো সরঞ্জাম খুবই কম।
ব্যবহারের ফলে পশ্চিমা মিসাইলের সংখ্যাও দিনে দিনে কমে আসছে। তবে গর্ডিভ জানান, এসব অস্ত্র তাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। যেমন কিছুদিন আগেই তার ইউনিট একটি রাশিয়ান ট্যাংক এন-ল দিয়ে ধবংস করেছে বলেও জানান তিনি।
পশ্চিমা অস্ত্রের চাহিদা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, "আমাদের এ ধরনের অস্ত্র খুবই দরকার। তবে ইউক্রেন সরকারের এ ধরনের অস্ত্র ফ্রন্টলাইনে পৌঁছে দেওয়ার সামর্থ্য দিন দিন কমে আসছে। তারপরও পশ্চিমা দুনিয়ার এ ধরনের অস্ত্র সহযোগিতা দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে এ যুদ্ধের ফলাফল।"
- সূত্র: বিবিসি